শহর জুড়ে নৈশতল্লাশিতে উল্লাসকর দত্ত, কানাইলাল দত্ত এবং আরও অনেকে ধরা পড়লেন। সবারই নিশিযাপন লালবাজারের লক আপে।
পরদিন সকালে হ্যালিডে সাহেব নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আটক বিপ্লবীদের। চেষ্টা করলেন অরবিন্দ ঘোষের থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের।
—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’
.
মামলার পোশাকি নাম, Emperor vs Barindra Kumar Ghosh and others, অধিক পরিচিত মানিকতলা বোমা মামলা বা আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান জারি থাকল মে মাস জুড়ে। শ্রীরামপুরের জমিদার পরিবারের নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী সক্রিয় সদস্য ছিলেন বারীনের গুপ্ত সমিতির। গ্রেফতার হলেন। সম্পর্কে অরবিন্দ-বারীনের মামা হতেন মেদিনীপুরের বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। যিনি বাংলার রেনেসাঁ-যুগের অন্যতম দিকপাল ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। সত্যেনের মেদিনীপুরের বাড়ি থেকে একটি পুরনো বন্দুক ও কুকরি উদ্ধার করল পুলিশ। এবং অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের পাশাপাশি তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হল আলিপুর মামলাতেও। প্রায় জনা চল্লিশেক বিপ্লবীর ঠাঁই হল আলিপুর জেলে, পরে যা প্রেসিডেন্সি জেল নামে পরিচিত হয়।
আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরকালীন দিকচিহ্ন এক। এই বহুচর্চিত মামলা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক, পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে একাধিক বই এবং পত্র-পত্রিকায়। সে বিবরণীর বিস্তার এই লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। ইতিহাসের সড়কপথে শুধু ফিরে দেখা মামলা চলাকালীন আলিপুর জেলের অভ্যন্তরে বঙ্গজ বিপ্লবীদের এক দুঃসাহসিক কীর্তিকে, যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।
২৪ পরগনার তৎকালীন জেলাশাসকের কাছে জবানবন্দি নথিবদ্ধ করার কাজ চলছিল মামলার প্রাথমিক পর্বে। নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর বয়ান নথিভুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল আলিপুর জেলে। অরবিন্দ তো বটেই, এ ছাড়াও সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত সহ আরও অনেকের নাম জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন নরেন। শুধু তাই নয়, সম্মত হয়েছেন রাজসাক্ষী হতে। বিনিময়ে বেকসুর খালাস হতে চলেছেন মামলা থেকে। আপাতত জেলবন্দি বিপ্লবীদের রোষ থেকে বাঁচাতে নরেনের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে। সর্বক্ষণের প্রহরায় নিযুক্ত হচ্ছেন হিগেনস্ নামের জেলকর্মী।
নরেন ছিলেন শ্রীরামপুরের জমিদারবাড়ির সন্তান। সম্ভ্রান্ত এবং বিত্তবান পরিবারের অসংখ্য স্বাধীনতাকামীর স্বেচ্ছায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের বহু উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু নরেনের বিপ্লবী হওয়াটা বহুলাংশে হুজুগই ছিল। সাময়িক সাধ হয়েছিল বিপ্লবী হওয়ার, দীর্ঘস্থায়ী পীড়ন সহ্য করার সাধ্য ছিল না। মামলায় অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল জেলের ৪৪ ডিগ্রি ওয়ার্ডে। সার দিয়ে কুঠুরি চুয়াল্লিশটি, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবেশের উপর প্রাকৃতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ সেখানে। বিলাসব্যসনে আশৈশব অভ্যস্ত নরেন দ্রুত পরাভব স্বীকার করেছিলেন ইন্দ্রিয়সুখের কাছে। বিপ্লবের থেকে কারামুক্তি অধিক কাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছিল। সে হলই বা বিশ্বাসভঙ্গের বিনিময়ে।
প্রেক্ষিতের প্রয়োজনে উল্লেখ্য, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার জেলবন্দি বিপ্লবীদের মধ্যে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ ছিল নরেনের স্বীকারোক্তি-উত্তর পর্যায়ে। বারীনের বরাবরের বিশ্বাস উগ্রপন্থায়। অহিংসায় তাঁর তীব্র বিরাগ। ছক কষছিলেন জেলে গুলি-বোমা-বন্দুক গোপনে আমদানি করে পালানোর। পক্ষান্তরে, সত্যেন বসু-কানাইলাল দত্ত-হেমচন্দ্র দাসের কাছে অগ্রাধিকার ছিল নরেনকে বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি দেওয়া। ওঁরা বারীনকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিলেন না পরিকল্পনা, সাহায্য চাইলেন জেল পালানোর অস্ত্র সরবরাহে। কথোপকথন হল বারীনের অজ্ঞাতে।
—হুঁ, মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …
—হ্যাঁ, আর্মস চাই। যেভাবেই হোক।
.
‘আর্মস’ জোগাড় হল। জেলে বন্দিদের সঙ্গে বন্ধুপরিজনদের সাক্ষাতের দিনটি নির্দিষ্ট ছিল প্রতি রবিবার। বহিরাগতদের আপাদমস্তক খানাতল্লাশির দায়িত্বে যে জেলকর্মীরা থাকতেন, যৎসামান্য উৎকোচের বিনিময়ে তাঁদের দলে টানলেন বারীন।
চন্দননগরের বিপ্লবী সুধাংশুজীবন রায় ২৩ অগস্ট বারীনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসাবে। প্রহরীদের প্রশ্রয়ে গরাদের মধ্য দিয়েই বারীনের হাতে চালান করে দিলেন রিভলভার। তার পরের রবিবার, ৩০ অগস্ট, একই প্রক্রিয়ায় চন্দননগরেরই শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে দ্বিতীয় রিভলভার হাতে এল বারীনের। একটি দিলেন কানাইলাল দত্তকে। অন্যটি পৌঁছল জেল হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন সত্যেন বসুর কাছে। যিনি দিনকয়েক আগে নরেনের কাছে খবর পাঠিয়েছেন, ‘এভাবে আর পারা যাচ্ছে না, আমিও রাজসাক্ষী হতে চাই’, এবং বার্তা পেয়ে নরেন দেখাও করে গিয়েছেন সত্যেনের সঙ্গে। জানিয়েছেন, ব্রিটিশ সরকার রাজসাক্ষ্যের বিনিময়ে সত্যেনকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।