.
দুই নিরপরাধ শ্বেতাঙ্গের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল ব্রিটিশ প্রশাসনে। প্রবল প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি শুরু করল শাসক, বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে।
ঘটনার পরদিনই জরুরি বৈঠক ডাকলেন নগরপাল হ্যালিডে। উপস্থিত সিআইডি-র ডিআইজি প্লাউডেন সাহেব। উপস্থিত গোয়েন্দাবিভাগের এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সমস্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। দীর্ঘ আলোচনার পর রূপরেখা প্রস্তুত হল নৈশতল্লাশির। তৈরি হল একাধিক দল, প্রতিটির নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং বিশ্বস্ত ‘ইনফর্মার’। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাকভোরে পুলিশ হানা দিল কলকাতার বিপ্লবীদের সম্ভাব্য ডেরাগুলিতে।
মানিকতলার ৩২, মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি যে আদতে বিপ্লবীদের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের সূতিকাগার, এমন তথ্য ছিলই গোয়েন্দাদের কাছে। এবং তথ্যে গরমিল ছিল না বিশেষ। অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই চূড়ান্ত অভীষ্টে পৌঁছনোর লক্ষ্যে তরুণ বিপ্লবীদের নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মকাণ্ড বারীন শুরু করেছিলেন মুরারিপুকুরের বাড়িটিতে। যোগশিক্ষা, গীতা-উপনিষদ পাঠের পাশাপাশি চলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে নিয়মিত ক্লাস। লাঠিখেলা-কুস্তি-জুজুৎসু তো ছিলই, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রক্রিয়া সিংহভাগ জুড়ে থাকত পাঠক্রমের।
২ মে-র ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ওয়াটারলু স্ট্রিট থানার ইনস্পেকটর J L Frizzoni-র নেতৃত্বে পুলিশ হানা দিল মুরারিপুকুর রোডের বাড়িতে। তল্লাশিতে উদ্ধার হল বিপুল পরিমাণে গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা-বিস্ফোরক তৈরির সামগ্রী। গ্রেফতার হলেন বারীন ঘোষ সহ ১৪ জন। পুলিশের নৈশ অভিযান চলল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট, ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট, ১৫ গোপীমোহন দত্ত লেন, ১৩৪ হ্যারিসন রোড, ৩০/২ হ্যারিসন রোড এবং ২৩ স্কট লেনেও। বাজেয়াপ্ত হল পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র-বোমা-কার্তুজ, জাতীয়তাবাদী পুস্তিকা-প্রবন্ধ-নথিপত্র।
বিপ্লবীদের সহিংস কর্মকাণ্ডে যিনি ছিলেন বোমা বানানোর প্রধান কারিগর, সেই হেমচন্দ্র দাস গ্রেফতার হলেন ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে। তল্লাশির নেতৃত্বে ছিলেন Superintendent C F Merriman. ১৩৪, হ্যারিসন রোডের একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকানে বিপ্লবীরা গোপনে মজুত রাখতেন বিস্ফোরক পদার্থ। Southern Division-এর Superintendent of Police Griffith Bowen-এর তত্ত্বাবধানে তছনছ করে দেওয়া হল সেই দোকান।
অরবিন্দ ঘোষকে পুলিশ গ্রেফতার করল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট থেকে। নগরপাল হ্যালিডের বিশেষ আস্থাভাজন Superintendent Richard Creagan ভোর পৌনে পাঁচটা নাগাদ হানা দিলেন দলবল নিয়ে। গ্রেফতারির বর্ণনা ধরা রয়েছে অরবিন্দের স্বরচিত ‘কারাকাহিনী’ বইটিতে। অংশবিশেষ তুলে দিলাম।
‘শুক্রবার রাত্রিতে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইয়াছিলাম, ভোরে প্রায় ৫টার সময় আমার ভগিনী সন্ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিল, জাগিয়া উঠিলাম। পরমুহুর্ত্তে ক্ষুদ্র ঘরটী সশস্ত্র পুলিশে ভরিয়া উঠিল; সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্রেগান, ২৪ পরগণার ক্লার্ক সাহেব, সুপরিচিত শ্রীমান বিনোদকুমার গুপ্তের লাবণ্যময় ও আনন্দদায়ক মূর্ত্তি, আর কয়েকজন ইনস্পেক্টর, লাল পাগড়ি, গোয়েন্দা, খানাতল্লাসীর সাক্ষী। হাতে পিস্তল লইয়া তাহারা বীরদর্পে দৌড়াইয়া আসিল, যেন বন্দুক-কামানসহ একটি সুরক্ষিত কেল্লা দখল করিতে আসিল। শুনিলাম, একটি শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ আমার ভগিনীর বুকের উপর পিস্তল ধরে, তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই। বিছানায় বসিয়া আছি, তখনও অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থা, ক্রেগান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অরবিন্দ ঘোষ কে, আপনিই কি?” আমি বলিলাম, “আমিই অরবিন্দ ঘোষ”। অমনি একজন পুলিশকে আমাকে গ্রেপ্তার করিতে বলেন। তাহার পর ক্রেগানের একটী অতিশয় অভদ্র কথায় দুজনের অল্পক্ষণ বাকবিতন্ডা হইল। আমি খানাতল্লাসীর ওয়ারেন্ট চাহিলাম, পড়িয়া তাহাতে সহি করিলাম। ওয়ারেন্টে বোমার কথা দেখিয়া বুঝিলাম, এই পুলিশ সৈন্যের আবির্ভাব মজঃফরপুরের খুনের সহিত সংশ্লিষ্ট। কেবল বুঝিলাম না আমার বাড়ীতে বোমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাইবার আগেই body warrant এর অভাবে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে। তবে সেই সম্বন্ধে বৃথা আপত্তি করিলাম না। তাহার পরেই ক্রেগানের হুকুমে আমার হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি দেওয়া হইল। একজন হিন্দুস্থানী কনস্টেবল সেই দড়ি ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া রহিল। ………… ক্রেগানের কথায় ভাবে প্রকাশ পাইল যে, তিনি যেন হিংস্র পশুর গর্ত্তে ঢুকিয়াছেন, যেন আমরা অশিক্ষিত হিংস্র স্বভাববিশিষ্ট আইনভঙ্গকারী, আমাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা বা ভদ্র কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। তবে ঝগড়ার পর সাহেব একটু নরম হইয়া পড়িলেন। বিনোদ বাবু তাঁহাকে আমার সম্বন্ধে কি বুঝাইতে চেষ্টা করেন। তাহার পর ক্রেগান আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি নাকি বি-এ পাশ করিয়াছেন? এইরূপ বাসায় এমন সজ্জাবিহীন কামরায় মাটিতে শুইয়াছিলেন, এই অবস্থায় থাকা কি আপনার মত শিক্ষিত লোকের পক্ষে লজ্জাজনক নহে?’’ আমি বলিলাম, ‘‘আমি দরিদ্র, দরিদ্রের মতই থাকি।’’ সাহেব অমনি সজোরে উত্তর করিলেন, ‘‘তবে কি ধনী লোক হইবেন বলিয়া এই সকল কাণ্ড ঘটাইয়াছেন?’’ দেশহিতৈষিতা, স্বার্থত্যাগ বা দারিদ্র ব্রতের মাহাত্ম্য এই স্থুলবুদ্ধি ইংরেজকে বোঝান দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া আমি সে চেষ্টা করিলাম না।’