চতুর্থ রাস্তা দেখিয়েছিলেন সুশীল স্বয়ং। বিভ্রান্ত সহযোদ্ধাদের দ্রুত বোঝাতে পেরেছিলেন, সবাই মিলে শহিদ হলে অভীষ্ট অধরাই থেকে যাবে চিরতরে। একজনের মৃত্যু তবু শ্রেয় দলগত আত্মহননের তুলনায়। লড়াইটা অন্তত আগামীতে জারি রাখবে বাকিরা। সঙ্গীরা অনুরোধ রেখেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের নয়, সতীর্থদের বুলেটেই অবশিষ্ট প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়েছিল তেইশ বছরের সুশীল সেনের। মৃতদেহ খুঁজে পেতে যাতে পুলিশের কালঘাম ছুটে যায়, চিহ্নিতকরণ হয় দুঃসাধ্য, সে পথও মৃত্যুর আগে সঙ্গীদের বাতলে দিয়েছিলেন সুশীল। পরিকল্পনা মতো সুশীলের মৃতদেহ খণ্ডিত করে বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে দিয়েছিলেন সতীর্থরা। হদিশই পায়নি পুলিশ।
সুশীল ‘সুশীল’ বালক ছিলেন না। সেই ছেলে ছিলেন না, যাঁকে বেত মেরে মা-ভোলানো যাবে।
০২. কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা
—না, মা আসবে না। কিছুতেই না। আমি কিছুতেই মায়ের সঙ্গে দেখা করব না। তোরা বারণ করে দে।
—কেন এমন করছিস? মাসিমা কয়েক মিনিটের জন্য তোকে দেখতে চাইছেন শুধু …
—বললাম তো না …
—না কেন? ছেলের সঙ্গে মা একবার শেষ দেখা করতে পারবে না? কীসের এত জেদ তোর?
—জেদ নয়, ভয়। মা যদি কান্নাকাটি শুরু করে, আমি সামলাতে পারব না নিজেকে। বোঝার চেষ্টা কর।
—তোরও বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
—বেশ, তোরা বোঝা মা’কে। আসুক, কিন্তু কোনও কান্নাকাটি চাই না। কোনও চোখের জল নয়। আমি ওতে দুর্বল হয়ে পড়ব।
—কাঁদবেন না, আমরা বোঝাব মাসিমাকে। তুই শুধু হ্যাঁ বল …
—হুঁ …
.
জেল-চত্বরে আলোচনা হচ্ছে যথাসম্ভব নিচু গলায়। প্রায় ফিসফিস করেই।
—কী! সব বলে দেবে বলেছে? বলে দিলে যে সর্বনাশ হবে!
—সে কি আর জানি না! শেষে কিনা এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা!
—কিন্তু খবরটা সত্যি তো? শিয়োর? স্বীকারোক্তি দেবে?
—একশো শতাংশ। ওকে বিশ্বাস করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। আর খবরের সত্যি-মিথ্যে? বুঝে গেছে সবাই। আলাদা ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করছে ওকে। পাছে আমরা ওর কোনও ক্ষতি করি। পাহারা বসছে সেলের সামনে।
—তাতে কী? পাহারা-টাহারা যা বসায় বসাক। গদ্দারির সাজা মৃত্যু। সবাইকে ফাঁসিয়ে পার পেয়ে যাবে এভাবে?
—কীভাবে মারা হবে? কে মারবে?
—সেটা সবাই মিলে ঠিক করতে হবে। অস্ত্র জোগাড় করাটা প্রথম কাজ।
—অত সোজা নাকি এখানে আর্মস ঢোকানো?
—সোজা তো সেভাবে দেখতে গেলে কিছুই নয়। কাজটা কঠিন, কিন্তু রাস্তা নিশ্চয়ই একটা বেরবে।
—আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে ওর গলা টিপে ধরতে …
—ওই বোকামোটা করতে গেলে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। মরতে হলে ওকে মেরে মরিস।
—হুঁ … মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …
—হ্যাঁ, আর্মস চাই, যেভাবেই হোক।
.
প্রায় সবারই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ সম্পূর্ণ। লালবাজারের লক-আপ থেকে নগরপালের চেম্বারে এক এক করে পেশ করা হয়েছে অভিযুক্তদের। বাকি শুধু একজন। যাঁকে সশস্ত্র প্রহরায় ঢোকানো হয়েছে নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র ঘরে। এই মধ্যতিরিশের লোকটি অন্যদের থেকে আলাদা, এক ঝলক দেখেই মনে হয় হ্যালিডে সাহেবের। আয়ত চক্ষু, প্রশান্ত মুখমণ্ডল। শরীরী ভাষায় উদ্বেগ নিরুদ্দেশ। নগরপাল প্রশ্ন ছুড়ে দেন সরাসরি।
—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’
যুবক নিরুত্তাপ।
—‘What right have you to assume that I was involved?’
নগরপাল ঝাঁঝিয়ে ওঠেন।
—‘I am not assuming, I know everything.’
যুবক অবিচলিত। শান্ত উত্তর আসে।
—‘What you know or do not know is your concern. I wholly deny having any connection with these murderous acts.’
.
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, সর্বজনজ্ঞাত তথ্য, জনমানসে উৎপন্ন করেছিল তীব্র ক্ষোভ। যা অনুঘটক হয়ে দেখা দিয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষে, বিপ্লবীদের একাধিক গুপ্ত সমিতির স্থাপনে আর ‘যুগান্তর’এবং ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো দেশাত্মবোধক প্রকাশনার পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধিতে। অত্যাচারী শাসকদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করে সশস্ত্র আক্রমণ এবং হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবীরা। ১৯০৭-এর শেষার্ধ থেকে ১৯০৮-এর এপ্রিলের মধ্যে একাধিক চেষ্টা হয়েছিল শাসকনিধনের।
বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন Sir Andrew Fraser। ১৯০৭-এর ৬ ডিসেম্বরে তাঁর ট্রেনযাত্রার সময় রেললাইনে বিস্ফোরণের চেষ্টা ব্যর্থ হল। চন্দননগরের তৎকালীন মেয়র L Tardivel স্বদেশি আন্দোলনকে যেনতেনপ্রকারেণ দমনের বিষয়ে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাও ব্যর্থ হল।
উপর্যুপরি তৃতীয় ব্যর্থতা এল কলকাতার তৎকালীন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে বই-বোমা পাঠিয়ে হত্যার প্রচেষ্টায়। মোড়কসুদ্ধ বই-বোমা পাড়ি দিল কিংসফোর্ডের পরবর্তী কর্মস্থল মুজফ্ফরপুরে। বদলির আদেশ এসেছিল তড়িঘড়ি, সময় হয়নি প্যাকেট খোলার।
কিংসফোর্ডের ভবলীলা সাঙ্গের চেষ্টা অবশ্য অব্যাহত ছিল। দুই তরুণ, ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকী, রওনা দিলেন মুজফ্ফরপুর। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের তৈরি বোমা নিয়ে।
পরের কাহিনি বহুশ্রুত, বহুপঠিত। ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিলের রাতে দুই বিপ্লবীর বোমা ছোড়া ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে, যাতে কিংসফোর্ড নন, ছিলেন দুই ইউরোপীয় রমণী। ঘটনাস্থলেই উভয়ের মৃত্যু এবং একটু পিছনের গাড়িতে থাকা কিংসফোর্ডের ফের রক্ষা পাওয়া বরাতজোরে।