প্রাথমিকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়লেও হাল ছাড়লেন না বিপ্লবীরা। মুজফ্ফরপুরে গিয়েই হত্যা করা হবে কিংসফোর্ডকে, সিদ্ধান্ত হল। বারীন ঘোষ নির্বাচন করলেন দুই ঘাতককে। সুশীল সেন এবং প্রফুল্ল চাকী। যথাক্রমে ‘দুর্গাদাস সেন’ এবং ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছদ্মনামে সুশীল-প্রফুল্ল সরেজমিনে ঘুরেও এলেন মুজফ্ফরপুর। দুই দফায় খুঁটিয়ে দেখে এলেন কিংসফোর্ডের বাংলোর অবস্থান। সাহেবের দৈনন্দিন গতিবিধির সম্পর্কে তৈরি করলেন সম্যক ধারণা।
চূড়ান্ত যাত্রার কয়েকদিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুশীলের বাবা। সিলেটের বাড়িতে কৈলাশচন্দ্র সেন তখন প্রায় মৃত্যুশয্যায়। একরোখা সুশীল জেদ ধরলেন, কিংসফোর্ড-নিধন সাঙ্গ করে তবেই যাবেন বাবাকে দেখতে। বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং অন্য বিপ্লবীরা বহু চেষ্টায় নিরস্ত করলেন সুশীলকে। পাঠালেন সিলেটে, বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। সুশীলের পরিবর্তে অন্য এক তরুণ মুজফ্ফরপুর পাড়ি দিলেন কিংসফোর্ড-হত্যার লক্ষ্যে। নাম? ক্ষুদিরাম বসু।
.
কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর দুঃসাহসিক অভিযানের দিনলিপি বহুআলোচিত, বহুপঠিত। বিস্তারিত নিষ্প্রয়োজন।
এই লেখার নিরিখে প্রাসঙ্গিক তথ্য এটুকুই, কিংসফোর্ড-হত্যার ব্যর্থ অভিযানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের গোপন ডেরাগুলিতে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ। সেই তল্লাশির সূত্রেই গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ-বারীন ঘোষ সহ অনেকে। উদ্ধার হয়েছিল প্রচুর গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা। শুরু হয়েছিল আলিপুর বোমা মামলা। এবং এই মামলার তদন্তেই পুলিশ হদিশ পেয়েছিল কিংসফোর্ডের বাংলোর গুদামঘরে একরাশ উপহারসামগ্রীর মধ্যে পড়ে থাকা বই-বোমার। আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত এক বিপ্লবীকে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছিল ‘কসাই কাজি’-কে হত্যার পরিকল্পনার ইতিবৃত্ত। বছর গড়িয়ে তখন ১৯০৯-এর ফেব্রুয়ারি। বই-বোমা পাঠানোর পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত।
ব্রিটিশ সরকারের ‘Sedition Committee’-র রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘A well known revolutionary, when in custody, said that a bomb had been sent to Mr. Kingsford in a parcel. The parcel did not contain a book; but the middle portion of the leaves had been cut away and the volume was thus in effect a box and in the hollow was contained a bomb with spring to cause the explosion if the book was opened.’
বই-বোমার কথা জানামাত্রই কলকাতা পুলিশ তড়িঘড়ি তারবার্তা পাঠিয়েছিল কিংসফোর্ডকে। বোমা বিশেষজ্ঞ Major Muspratt Williams-কে সদলবলে মুজফ্ফরপুর পাঠানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। বাংলোর গুদাম থেকে যথোচিত সতর্কতায় বই-বোমা আনা হয়েছিল কলকাতায়। নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিল তৎকালীন নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র কিড স্ট্রিটের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের পর মেজর উইলিয়ামস ১৯০৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন সরকারকে, ‘…I proceeded to Muzaffarpore on the evening of the 22nd, arriving there next morning at 10 AM and was met by Mr. Kingsford, ICS and Mr. Armstrong, Superintendent of Police…. I placed the bomb in my own hand bag, having first wrapped it in cotton wool, and I padded it all round with cotton wool taken out of a cushion. I then caught the afternoon train back to Calcutta on the morning of 24th… I took the bomb to the compound of Mr. F L Halliday, CIE, MVO, Commissioner of Police, and was accompanied by Mr. Denham, who kindly assisted me in conducting operation, as also did Mr. Halliday.’
রিপোর্টে উইলিয়ামস লিখেছিলেন স্পষ্ট, কার্যকারিতায় কী মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারত ওই বই-বোমা, ‘There is no doubt this would have been a most destructive bomb, had it exploded.’
বই-বোমাটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল সযত্নে। রক্ষিত আছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে আমাদের পুলিশ মিউজিয়ামে, ভারতের ইতিহাসে IED ব্যবহারের সম্ভবত প্রথম নিদর্শন হিসাবে।
.
সুশীল স্বাধীনতা আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন পরবর্তী জীবনে। অরবিন্দ ঘোষের প্রেরণায় উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ম্যাট্রিকে চতুর্দশ স্থান, স্নাতক স্তরে রসায়নে স্বর্ণপদক। প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠরত অবস্থায় ইডেন হিন্দু হস্টেলে আলাপ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনের সঙ্গে, ফের উজ্জীবিত হওয়া দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে।
বীরোচিত মৃত্যুবরণ ১৯১৫-য়। নদিয়ায় এক গোপন সশস্ত্র অভিযান চলাকালীন। ব্রিটিশ বাহিনীর চক্রব্যূহে আটকে পড়েছিল ছ’জনের দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন সুশীল। মজুত গুলিও প্রায় শেষ। সুশীলের দু’পায়েই গুলি লেগেছিল। চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতির বিচারে আপাতদৃষ্টিতে তিনটি রাস্তা খোলা ছিল। এক, পুরো দলটিরই আত্মসমর্পণ। দুই, অসম যুদ্ধ অব্যাহত রেখে মৃত্যুকে সমবেত স্বেচ্ছা-আহ্বান। এবং তিন, গুলিবিদ্ধ সুশীলকে ফেলে রেখে পশ্চাদপসরণ, যা কোনও অবস্থাতেই করতেন না সহযোদ্ধারা।