প্রথম বুলেট যখন ছিটকে এল বীণার রিভলভার থেকে, জ্যাকসন মাথা সরালেন নিমেষে, বাউন্সারে ‘ডাক’ করার ভঙ্গিতে। বাঁচিয়ে দিল স্বভাবজাত ক্রিকেটীয় রিফ্লেক্স, মাথার দু’ ইঞ্চি পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। হুলুস্থুল পড়ে গেল সেনেট হলে। উপাচার্য হাসান সুহরাওয়ার্দী চকিতে মঞ্চ থেকে নেমে চেপে ধরলেন বীণার ঘাড়। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বীণাকেও দিশেহারা দেখাচ্ছে তখন। ট্রিগার চাপলেন মরিয়া, পরপর তিনবার। জ্যাকসন ততক্ষণে সরে গিয়েছেন একপাশে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেনেট হলে উপস্থিত সাদা পোশাকের পুলিশ ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ধরে ফেলল একুশ বছরের যুবতীকে। পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেটে হাত দেওয়ার আগেই।
খবর ছড়িয়ে পড়ল উল্কাগতিতে। ডিগ্রি নেওয়ার অনুষ্ঠানে গভর্নরের উপর গুলি চালিয়েছে এক ছাত্রী। অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা হয়েছে রাজ্যপালের।
পরের দিনের কাগজে হেডিং : ‘Girl assassin shoots at Governor, misses target.’
.
বীণাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ইলিসিয়াম রো (বর্তমানের লর্ড সিনহা রোড)-র অফিসে। সেখান থেকে লালবাজার। জিজ্ঞাসাবাদে শারীরিক নির্যাতন ততটা ছিল না, যতটা ছিল অসম্মানজনক প্রশ্নাবলিতে মানসিক নির্যাতন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বীণা মুখ খুললেন না পুলিশকর্তাদের শত চেষ্টাতেও। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ ধরল কমলাকেও, মার্চের পয়লা তারিখ। ছয় বছরের কারাবাস বরাদ্দ হল কমলা দাশগুপ্তের।
বীণার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হল ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭ (খুনের চেষ্টা) ধারা এবং অস্ত্র আইনে। ডায়াসেশন স্কুলের হস্টেলের একটি ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন কিছু গুলি। যা উদ্ধার করল পুলিশ। বীণা নির্দ্বিধায় দোষ কবুল করে নেওয়ায় বিচারপর্ব সম্পন্ন হল দিনসাতেকের মধ্যেই। রায় বেরল ১৫ ফেব্রুয়ারি। নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বীণা ঘোষণা করলেন সদর্পে, ‘হ্যাঁ, আমি রাজ্যপালকে মারতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, পারিনি। স্ট্যানলি জ্যাকসন আমার পিতৃপ্রতিম, তাঁর বা তাঁর পরিবারের প্রতি আমার কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই, কখনও ছিল না। কিন্তু তিনি এমন এক সরকারের প্রতিভূ, এমন এক শাসনব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক, এমন এক supreme symbol, যা আমার দেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছে দমনপীড়নের মাধ্যমে। আমি আঘাত হানতে চেয়েছিলাম সেই প্রতীকের উপর।’
জ্যাকসন বেঁচে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা বৃথা যায়নি বীণার। তাঁর অকুতোভয় অভিযান যে ব্রিটিশ সরকারকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সমসময়ের নথিপত্রে তার প্রমাণ মেলে। শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতের ক্রোধ-ক্ষোভ-ঘৃণা কোন অসহনীয় পর্যায়ে গেলে কলেজছাত্রী রাজ্যপালকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় কনভোকেশনে, বুঝতে বাকি থাকেনি প্রশাসনের। রাতারাতি নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের। যাঁদের সাময়িক হলেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল প্রাণভয়।
কারাবাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দু’বছর আগে রাজবন্দিনি হিসাবে মুক্তি পান বীণা, ১৯৩৯ সালে। যোগ দেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। সক্রিয় অংশ নেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ফের গ্রেফতার বরণ, তিন বছরের কারাবাস। Bengal Provincial Legislative Assembly (স্বাধীনতার পর West Bengal Legislative Assembly)-র সদস্যা ছিলেন ১৯৪৬-৫১। স্বাধীনতা যখন আসন্ন, লিখেছিলেন নিজের জীবনকথা, ‘শৃঙ্খল-ঝঙ্কার’। সহযোদ্ধা বিপ্লবী যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে বিবাহ স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছরে।
শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন পাহাড়ের কোলে, হৃষীকেশে। প্রয়াণ ১৯৮৬-র ২৬ অক্টোবর। অবহেলায়, একাকী, লোকচক্ষুর অন্তরালে।
.
অগ্নিযুগের বাংলায় নারীশক্তির ভূমিকা এবং অবদান নিয়ে বইপত্র আছে কিছু। গবেষণাও যে অমিল, এমন নয়। কিন্তু বীণা দাসের মতো অগণিত দেশব্রতী নারী আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিযাত্রায়, তা যে প্রাপ্য প্রচার এবং মূল্যায়ন থেকে অনেকাংশে বঞ্চিতই থেকেছে ইতিহাসের পাতায়, লেখাই যায় সংশয়হীন।
ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে বাংলার বিপ্লবী নারীদের অবদানের পুনর্মূল্যায়নের। সময় এসেছে মনে রাখার, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।