—আবেগ দিয়ে সব লড়াই হয় না বীণা, তা ছাড়া এটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে যাবে। ধরা পড়বিই, জীবনটাই হয়তো জেলে কেটে যাবে। লড়াইটাই করতে পারবি না আর।
—শুধু আবেগ দিয়ে তো লড়ছি না দিদি। লড়ছি তো বুদ্ধি দিয়েও। ধরা পড়ব, সেটাও জানি। পালানোর জন্য তো যাচ্ছি না ওখানে। যে-কোনও শাস্তির জন্য প্রস্তুত। তুমি আর ‘না’ কোরো না, একটা রিভলভার জোগাড় করে দাও।
—যদি ফাঁসি হয় তোর?
—আমি হাসতে হাসতে চলে যাব, দেখো তুমি।
—যদি দ্বীপান্তর হয়, পারবি সহ্য করতে?
—হলেও কোনও চিন্তা নেই। ওখানে তো শান্তি-সুনীতি আছে, ওদের পড়িয়ে দিব্যি সময় কাটবে।
—পুলিশের অত্যাচার যদি সহ্য করতে না পারিস?
—সে সুযোগ ওরা যাতে না পায় সেই চেষ্টা তো করবই। পটাশিয়াম সায়ানাইড তো থাকছেই পকেটে।
কমলা বুঝে যান, এ মেয়ে মনস্থির করে ফেলেছে। একে আর বোঝানো বৃথা। তবু বোঝালেন পরের কয়েকদিন আপ্রাণ। বীণা অনড় থাকলেন সিদ্ধান্তে। ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুধীর ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করলেন কমলা। রিভলভার কেনার ২৮০ টাকা জোগাড় করলেন, যা দিয়ে সুধীর ব্যবস্থা করলেন আগ্নেয়াস্ত্রের। পাঁচ চেম্বার বিশিষ্ট .৩৮০ বোরের বেলজিয়ান রিভলভার। কমলা যা হাতে তুলে দিলেন বীণার, সঙ্গে কার্তুজ আর পটাশিয়াম সায়ানাইড। বিশদে বুঝিয়ে দিলেন অস্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি।
—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগারে চাপ দিলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে… শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’… তুই কীভাবে অস্ত্রটাকে ধরছিস…
.
৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল গমগম করছে। তিলধারণের স্থান নেই।
—আজ আমরা সমবেত হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজ এক গর্বের দিন। গর্ব আমাদেরও, কারণ, আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করছেন বাংলার মহামান্য রাজ্যপাল স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। যাঁর কাছে আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ তাঁর মহামূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাদের জন্য ব্যয় করতে সম্মত হওয়ায়।’
চতুর্থ সারিতে বসা বীণার কানে একটা শব্দও ঢুকছে না। চারপাশে একবার তাকায়। হলভর্তি লোক মনোযোগ দিয়ে শুনছে উপাচার্যের স্বাগত ভাষণ। বিরক্ত লাগে বীণার। এত মন দিয়ে কী শুনছে এরা? একই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ই তো চলে আসছে বছরের পর বছর। কখন শেষ হবে এই চর্বিত চর্বণ? কখন শুরু হবে রাজ্যপালের অভিভাষণ?
কালো গাউনের ভিতরের ডান দিকের পকেটে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের উপর একবার হাত বুলিয়ে নেয় সে। পটাশিয়াম সায়ানাইড রাখা আছে বাঁ দিকের পকেটে। আলতো ছুঁয়ে দেখে। মনে মনে আর একবার ঝালিয়ে নেয় প্ল্যান।
স্ট্যানলি জ্যাকসনকে মারতে হবে, যখন ভাষণ দিতে উঠবেন, শুরু করবেন বক্তৃতা। এখন মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন মাঝের চেয়ারে। দু’পাশে আরও আটটা চেয়ারে বাকি বিশিষ্টরা। এখন কিছু করা মুশকিল। ঠিকই করে এসেছে সে, যখন বক্তৃতা দেবেন পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে, তখনই মোক্ষম সময়। কিন্তু ভাষণটা শুরু হবে কখন? আর কত দেরি? উসখুস করতে থাকে সে। শুভস্য শীঘ্রম।
—এখন বক্তব্য পেশ করবেন প্রধান অতিথি স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন, যাঁর মূল্যবান উপদেশ ছাত্রছাত্রীদের আগামীদিনের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।
বীণার স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে নিমেষে। অবশেষে! উপস্থিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ব্রিটিশরাজের প্রভুত্বে প্রকাশ্য আঘাত হানার। রিভলভারে শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে নেয় বীণা। কী কী যেন বলেছিল কমলাদি? গ্রিপটাই আসল… ফোরসাইট ইউ… আর যেন কী? মনে পড়ছে না কেন? কতবার ড্রাই প্র্যাকটিস করেছে গত সপ্তাহে, হিসাব নেই কোনও। তবু গুলিয়ে যাচ্ছে কেন শেষ সময়ে? গলাটাও একটু শুকিয়ে গেছে যেন। একটু জল পেলে ভাল হত। এমন হচ্ছে কেন? ভয়?
মানসিক অস্থিরতায় চিরকাল যা করে এসেছেন, সেটাই করেন বীণা। বাবাকে স্মরণ করেন। বেণীমাধব প্রায়ই বলেন, জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে, ভয় পাবি না কখনও। ভয়কে জয় করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আদর্শে যদি বিশ্বাস স্থির থাকে, ‘ভয়’ নিজেই ভয় পেয়ে পালাবে। বুক চিতিয়ে দাঁড়াবি ‘ভয়ের’ সামনে।
রাজ্যপালকে খুন করেছে আদরের মেয়ে, এটা জানলে কি বাবা খুশি হবেন? মনে হয় না। বরং ৬৭/১ একডালিয়া রোডের বাড়িতে বসে বাবা দুঃখ পাবেন খুব, মা-ও। বেণীমাধব নিখাদ দেশপ্রেমিক, কিন্তু উগ্র সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না কোনওদিন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, সহিংস না হয়ে উপায়ই বা কী আর? শাসকের উগ্র দমনপীড়নের মুখে কতদিন আর অহিংস থাকা যায়? কতদিন অন্য গাল বাড়িয়ে দেওয়া যায় এক গালে থাপ্পড় খাওয়ার পর? বীণা উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে।
—Ladies and Gentlemen, distinguished guests and my dear students…
It is indeed a privilege for me…
মধ্যপথে থেমে যান দীর্ঘদেহী রাজ্যপাল। ওই কালো গাউন পরা মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে ওভাবে ছুটে আসছে কেন তাঁর দিকে? কী বার করছে ওটা? আরে, ওটা তো রিভলভার!
জ্যাকসন ছিলেন শারীরিক ভাবে অত্যন্ত সক্ষম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেটার ছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে কুড়িটা টেস্ট খেলেছিলেন। মূলত ব্যাটসম্যান এবং পার্টটাইম বোলার। পরিসংখ্যান, টেস্ট কেরিয়ারে মোট রান ১৪১৫, গড় ৪৮.৭৯। পাঁচটি সেঞ্চুরি সহ। উইকেট ২৪, গড় ৩৩.২৯।