‘ছাত্রীসংঘ’-র মেয়েদের দিন কাটত হইহই ব্যস্ততায়। সারাদিন ক্লাস করার পর কোনওদিন লাঠিখেলায় মেতে ওঠা ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে। কোনওদিন ছুরি চালানোর অনুশীলন লাগাতার। কখনও দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়া কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে। কখনও দ্রুত সাইকেল চালানোর মহড়া। পাশাপাশি ফার্স্ট এইড-এর প্রাথমিক পাঠ নিয়মিত।
দেশে চলছে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির নিরন্তর সংগ্রাম,‘ছাত্রীসংঘ’ সেই লড়াইয়ের আঁচমুক্ত থাকে কী করে? যে-কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় নিজেদের মানসিক এবং শারীরিক ভাবে তৈরি রাখতে স্কুল-কলেজের একঝাঁক ছাত্রী ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। জন্মভূমির হিতার্থে যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত।
দেশ জুড়ে তখন চলছে আইন অমান্য আন্দোলন। কলেজে কলেজে শুরু হল পিকেটিং। ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল শহরের বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের লাগাতার এবং সোচ্চার পিকেটিং চিন্তায় ফেলল লালবাজারকে।
কড়া হাতে দমনের সিদ্ধান্ত হল। অনেক হয়েছে, ছাত্র আন্দোলন এর বেশি বাড়তে দেওয়া যায় না। ফোর্স রওনা দিল কলেজ স্ট্রিটে। নির্দেশ স্পষ্ট, লাঠিপেটায় মিটে গেলে ভাল, না মিটলে প্রয়োজনে গুলি। পরের ঘটনাক্রম লিখেছি আগে, বেথুন কলেজের গেট থেকে ছাত্রীদের প্রেসিডেন্সি যাত্রা, মানবশৃঙ্খল গড়ে তোলা এবং কিংকতর্ব্যবিমূঢ় পুলিশের রণে ভঙ্গ দেওয়া।
ছাত্রীদলের নেতৃত্বে থাকা মেয়েটিকে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন লালবাজারের পোড়খাওয়া অফিসার। কে ওই মেয়েটি, যে উদ্যত বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে সটান বলেছিল, ‘over our dead bodies?’ কী নাম ওই দৃপ্ত যুবতীর?
.
বীণা দাস। দিদি কল্যাণী ছিলেন স্থিতধী সংগঠক। বীণা তুলনায় বেশি আবেগপ্রবণ, বেপরোয়া। মিষ্টি স্বভাবের জন্য স্কুলে তুমুল জনপ্রিয়। ছাত্রীরা তো বটেই, স্কুলের সিস্টাররাও চোখে হারান বীণাকে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান তো বাঁধাই, বিতর্কে-আবৃত্তিতে-গল্প লেখায় ধারেকাছে কেউ নেই। সিস্টারদের অনেক আশা প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে। অধ্যাপনা করবে, নাকি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (ICS) বসবে? মেয়ের যা এলেম, যে পেশাতেই যাক, সিদ্ধিলাভ অনিবার্য।
বীণা অবশ্য প্রথামাফিক ‘ভাল মেয়ে’ হওয়ায় তীব্র অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন ততদিনে। চারদিকে যা ঘটছে, নিয়মনিষ্ঠ জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোতে মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। বেথুন কলেজে ভর্তি হলেন স্কুলের পাট চুকিয়ে। দুই সহপাঠী, সুহাসিনী দত্ত এবং শান্তি দাশগুপ্ত ছিলেন একটি ছোট বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপে বীণা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। যোগ দিলেন বন্ধুদের গোষ্ঠীতে, দেশের জন্য সীমিত সাধ্যে কিছু করার সুযোগ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা প্রায়।
তিরিশের দশকের প্রথমার্ধ। সে বড় অস্থিরতার সময় বাংলায়। বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দুঃসাহসিক প্রয়াস আলোড়ন ফেলে দিয়েছে দেশময়। কয়েকমাস পরে অগস্টের ২৫ তারিখে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা হল ডালহৌসি স্কোয়ারে। নিহত হলেন অনুজাচরণ সেনগুপ্ত। গ্রেফতার হলেন দীনেশ মজুমদার।
ঢাকায় ইনস্পেকটর জেনারেল লোম্যানকে গুলি করে হত্যা করে বিপ্লবী বিনয় বসু তখন পলাতক। কিছুদিন পরে ফের আবির্ভাব বিনয়ের, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্তের সঙ্গে।’৩০-এর ডিসেম্বরের ৮ তারিখে রাইটার্সের বিখ্যাত অলিন্দ যুদ্ধে ত্রিমূর্তির অভিযান, গুলি করে হত্যা অত্যাচারী পুলিশ অফিসার সিম্পসনকে।’৩১-এর শেষার্ধে দুই স্কুলকিশোরী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী ঘটাল এক অভাবনীয় ঘটনা। কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করে দ্বীপান্তরিত হল যাবজ্জীবন।
প্রত্যাঘাতে প্রতিহিংসাই দস্তুর ছিল ব্রিটিশ সরকারের। ধরপাকড় শুরু হল বেপরোয়া। বীণাদের ছোট দলটির অনেকেও গ্রেফতার হলেন। বিচলিত বীণা স্থির করলেন, এবার এমন কিছু করবেন, এবং একাই করবেন, যাতে ভিত নাড়িয়ে দেওয়া যায় প্রশাসনের। আতঙ্ক গ্রাস করে পুলিশকে।
কিন্তু কী করবেন? চিন্তা করতে থাকেন সারারাত। নিদ্রাহীন।
একসময় ভাবনা আসে বিদ্যুৎঝলকের মতো, উঠে পড়েন ধড়মড়িয়ে। আজই একবার ‘দিদি’র বাড়ি যাওয়া দরকার।
.
—তুই যা বলছিস, ভেবেচিন্তে বলছিস? অত সোজা নয়…
কমলা দাশগুপ্ত প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন বীণার পরিকল্পনা। কমলার জন্ম ঢাকায়, ১৯০৭ সালে। বেথুন কলেজে বিএ পড়ার সময় বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন, স্নাতকোত্তর পড়াকালীন যোগ দেন ‘যুগান্তর’ দলে। দলের প্রয়োজনে বাড়ি ছেড়ে থাকতেন একটি মেয়েদের হস্টেলের ম্যানেজার হিসাবে। বোমা-পিস্তল রাখা এবং বিপ্লবীদের সরবরাহ করার কাজ করতেন হস্টেল থেকেই। পিস্তল ব্যবহারে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
বীণা তাঁর সহপাঠী কল্যাণীর ছোট বোন, বেথুনেরই ছাত্রী। কমলা খুব স্নেহ করেন হাসিখুশি স্বভাবের মেয়েটিকে। দেশপ্রেমের আদর্শে স্থির, কিন্তু একটু বেশি আবেগপ্রবণ। এত বড় সিদ্ধান্ত কি স্রেফ আবেগের বশে নেওয়া উচিত?