.
হাঁফাতে হাঁফাতে বেথুন কলেজের গেটে এসে পৌঁছন ইলা সেন। কলেজেরই ছাত্রী, উত্তেজনায় গলা কাঁপছে।
—এইমাত্র খবর পেলাম, প্রেসিডেন্সির পিকেটারদের মেরে সরিয়ে দেবে পুলিশ। লালবাজার থেকে ফোর্স রওনা দিয়েছে। প্রয়োজনে নাকি গুলি চালাবে।
—সে কী! এক্ষুনি চল!
আইন অমান্য আন্দোলনের সমর্থনে বেথুন কলেজের সামনে পিকেটিং করছিলেন ছাত্রীরা। শুধু বেথুনেরই নন, অন্য কলেজের ছাত্রীরাও রয়েছেন। ইলার মুখে খবর পেয়েই দৌড়লেন দল বেঁধে। গন্তব্য, প্রেসিডেন্সি কলেজ। যেখানে ছাত্রদের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগানে তখন ঝনঝনিয়ে উঠেছে বইপাড়া।
ছাত্রীরা যখন পৌঁছলেন, রণভূমির চেহারা নিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের এ মাথা থেকে ও মাথা। পুলিশের সঙ্গে প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে ছাত্রদের। পিকেটিং কিছুতেই চলতে দেবে না উর্দিধারীরা, আর ছাত্ররাও যেনতেনপ্রকারণে জারি রাখবে আইন অমান্য আন্দোলন। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে গোলমালের জেরে। বাস-ট্রাম দাঁড়িয়ে স্থাণুবৎ।
লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েও লাভ হচ্ছে না যখন বিশেষ, বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা অফিসার নির্দেশ দিলেন সশস্ত্র সিপাইদের, গুলিচালনার প্রস্তুতি নিতে।
ছাত্রীদল সিদ্ধান্ত নিলেন মুহূর্তের মধ্যে। গুলি চালাবে? বললেই হল? চালাক দেখি! দেখি, কত গুলি আছে ওদের? হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন ছাত্রদের সামনে। চালাক গুলি, তবে আগে আমাদের উপর।
সে এক দৃশ্য! মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ফেলেছে একদল কলেজছাত্রী। ঘিরে রেখেছে প্রেসিডেন্সির বিক্ষোভরত ছাত্রদের। বিনা যুদ্ধে এক সেন্টিমিটারও জমি ছাড়ার প্রশ্নই নেই। ছাত্রীদের এহেন রণং দেহি মূর্তিতে হতচকিত হয়ে পড়ল পুলিশ, স্তিমিত হয়ে পড়ল আগ্নেয়াস্ত্রের আস্ফালন।
অফিসার থামালেন সিপাইদের। একদল নিরস্ত্র কলেজছাত্রীর উপর গুলি চালানো অসম্ভব। হিতে বিপরীত হবে। প্রতিবাদের আগুন শুধু শহরে নয়, ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী। এ ঝুঁকি নেওয়া যায় না। পিছু হঠতে বাধ্য হল পুলিশ। ব্যাক টু লালবাজার।
ফিরে যাওয়ার আগে অফিসার সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকান ছাত্রীব্যূহের একদম মাঝখানে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। যে অবিচলিত ভঙ্গিতে একটু আগেই তাঁর চোখে চোখ রেখে চোস্ত ইংরেজিতে বলেছে, ‘Break the cordon if you must… but be sure, over our dead bodies!’
‘অবরোধ সরাতে হলে সরান, কিন্তু আমাদের মৃতদেহের উপর দিয়ে যেতে হবে!’ কে মেয়েটি? বয়স তো দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি হলে আঠারো-উনিশ। এই সহজাত সাহস এত অল্প বয়সে আসে কোথা থেকে?
ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে স্টার্ট দেন অফিসার। জয়ধ্বনি কানে আসে ছাত্রছাত্রীদের। বন্দে মাতরম! কানে আসে সমস্বরে রবিঠাকুরের গান, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার…’
.
কটকের Ravenshaw Collegiate School-এর প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। স্ত্রী সরলা আর দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। কল্যাণী বড়, তার চার বছরের ছোট বীণা। ইনিই সেই বেণীমাধব, যাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার অভিযোগ এনেছিল স্কুলে স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের, রাতারাতি বদলি করে দেওয়া হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, যাঁর দেশপ্রেমের আদর্শ গভীর প্রভাব ফেলেছিল কটকের ওই স্কুলেই পাঠরত ছাত্র সুভাষচন্দ্রের চেতনায়-মননে।
কল্যাণী-বীণার শৈশব এবং কৈশোরে বাবা-মা ছাড়াও প্রভাব ছিল বড়মামার। অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের। যাঁর প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের প্রভাব সে যুগে জাতির চরিত্রগঠনে ছিল সুদূরপ্রসারী।
বাবা সন্ধেবেলা গল্প বলতেন বিভিন্ন দেশের বরণীয় সমাজবিপ্লবীদের, শোনাতেন দেশের জন্য তাঁদের নিঃস্বার্থ ত্যাগস্বীকারের কাহিনি। দুই বোন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনত মন্ত্রমুগ্ধ।
সরলা তাড়া দিতেন মেয়েদের…
—হ্যাঁ রে, তোরা শুবি না? অনেক রাত হল, কাল স্কুল আছে তো!
—মা… প্লিজ় আর একটু… বাবা গল্পটা শেষ করুক।
প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন সরলা। ভাবতেন, ওদের এসব শোনাই উচিত, তবে না চরিত্রের বুনিয়াদ মজবুত হবে। স্বামী-কন্যাদের সঙ্গে নিজেও যোগ দিতেন গল্পে।
সরলার বিরল সংগঠনী ক্ষমতা ছিল। ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত নীতি-বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো ছিলই, পাশাপাশি দুঃস্থ মহিলাদের জন্য ‘পুণ্যাশ্রম’ গড়ে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়।
সেটা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ। কল্যাণীর জন্ম ১৯০৭ সালে, বীণার’১১-য়। উদারমনস্ক শিক্ষিত পরিবারে এমন মা-বাবার ভাবধারায় বেড়ে ওঠা দুই কিশোরী যে গতানুগতিক জীবনে আকৃষ্ট হবেন না, দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে যে পরাধীনতার গ্লানিতে অবধারিত আক্রান্ত হবেন, স্বাভাবিকই ছিল।
কল্যাণীর ছিল মায়ের মতোই সাংগঠনিক দক্ষতা। ১৯২৮ সালে বিএ পাশ করার পর কলকাতায় এলেন এমএ পড়তে। সহপাঠী সুরমা মিত্র, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন ‘ছাত্রীসংঘ’। সভানেত্রী সুরমা, সম্পাদিকা কল্যাণী। কলকাতার স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে সংগঠন। ক্রমে ব্যাপ্তি বাড়ল, যোগ দিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, সুলতা করের মতো ছাত্রীরা, যাঁরা পরে সক্রিয় অংশ নেবেন দেশমুক্তির সংগ্রামে। এলেন কল্যাণীর সহোদরা বীণাও, যিনি তখন এলগিন রোডের St Johns Diocesan Girls’ Higher Secondary School-এর ছাত্রী।