সাড়া মেলেনি বিজ্ঞাপনে। ঘটনার এক বছর তিন মাস পর মৃতদেহের ছবি দেখে কানাইলালকে চিহ্নিত করেছিলেন একজন। উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বিপ্লবীদের। গার্লিক নিহত, অথচ পুলিশ অন্ধকারে ছিল এক বছরেরও বেশি।
কানাই মা-কে বলে গিয়েছিলেন, দেরি হলে চিঠি লিখবেন। মা অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। চিঠি আসেনি। দুঃসংবাদ এসেছিল।
.
কানাই একা নন। তাঁর মতো এমন যে কত, যাঁরা অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, যাঁদের না ছিল অমরত্বের প্রত্যাশা, না ছিল ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। প্রত্যাশিত পরিণাম— বিস্মৃতি!
কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!
১০. কে ওই মেয়েটি?
এই প্রথম!
ছবিতে দেখেছেন আগে। চাক্ষুষ এই প্রথম। যুবতী হাতে তুলে নেন ধাতব আগ্নেয়াস্ত্র, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন বারবার। রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা পাল্লা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে শিরা-উপশিরায়। এই তা হলে রিভলভার, আসল! কিন্তু গুলি কোথায়, কার্তুজ? তর সয় না যুবতীর, জিজ্ঞেস করেই ফেলেন।
—দিদি… বুলেট?
‘দিদি’ হাসেন সস্নেহে, টের পান একুশ বছরের যুবতীর ছটফটানি।
—বুলেট পরে। কীভাবে যন্ত্রটা ব্যবহার করবি সেটা আগে দেখিয়ে দিই। ভাল করে বুঝে না নিলে এ যন্ত্র কিন্তু পোষ মানার নয়। দে ওটা আমায়…
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিভলভারের হাতবদলে বাধ্য হন যুবতী। খুঁটিনাটি বোঝাতে শুরু করেন ‘দিদি’।
—বুলেট চাইছিলি না? বুলেট ঢোকাতে হয় চেম্বারে। এই হল চেম্বার। এইভাবে খুলবি আর একটা একটা করে গুলি ঢোকাবি এই পাঁচটা ফুটোর মধ্যে। এবার চেম্বারটা দ্যাখ কীভাবে বন্ধ করছি। হল বন্ধ? ব্যস, তোর রিভলভার এখন লোডেড।
যুবতী শুনতে থাকেন অখণ্ড মনোযোগে।
—এইটা হল ব্যারেল, ট্রিগার টিপলে যেখান থেকে গুলি ছুটবে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবি, লোড যখন করবি, মানে বুলেট ভরবি যখন চেম্বারে, ব্যারেলের মুখ কক্ষনো নিজের দিকে রাখবি না, নেভার! কোনওভাবে অসাবধানে ট্রিগারে হাত পড়ে গেলে নিজেই অক্কা পাবি। ভরবি সাইড করে, এইভাবে।
শুটিংয়ে আসল কথা কিন্তু ‘গ্রিপ’, তুই কীভাবে ধরছিস অস্ত্রটাকে। লক্ষ কর, আমি কীভাবে ধরছি। আঙুলগুলোর পজিশন দ্যাখ মন দিয়ে। ধরলি? এবার নিশানা। এই যে সামান্য উঁচু জিনিসটা ব্যারেলের সামনের দিকে দেখছিস, একে বলে ‘ফোরসাইট ইউ’। টার্গেটের সঙ্গে এটাকে স্ট্রেট লাইনে রাখলে মিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। ধর, আমি তোকে গুলি করব মাথায়… একটু দূরে গিয়ে দাঁড়া… দ্যাখ… তোর মাথার সঙ্গে কীভাবে স্ট্রেট লাইনে ‘align’ করছি ‘ফোরসাইট ইউ’…
গুলি যখন করবি, গায়ের জোরে ট্রিগার চাপবি না। সামান্য চাপই যথেষ্ট। আর হ্যাঁ, যেটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, কাঁধ থেকে হাতের কবজি অবধি পুরো সোজা রাখবি, টানটান। একদম ‘locked’ থাকবে ওই অংশটা, ‘muscle movement’ হবে মিনিমাম। যা বললাম, বুঝলি? গুলি না ভরে, যেভাবে বললাম, কয়েকদিন ‘dry practice’ করলেই দেখবি সড়গড় হয়ে যাবে। এবার, এই নে তোর বুলেট।
কাঁধের ঝোলা থেকে মহিলা বার করেন চামড়ার ছোট থলি, উপুড় করে দেন টেবিলে। ঠনঠন শব্দে ছড়িয়ে পড়ে এক ডজন কার্তুজ। যুবতী চেম্বারে বুলেট ভরার মহড়া শুরু করেন। এক… দুই… তিন… চার।
‘দিদি’ দেখতে থাকেন নিষ্পলক। একটু পরে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, কী রে, পারবি তো?
যুবতী চোখ তুলে তাকান। হাসিখুশি মুখটা বদলে গিয়েছে কঠিন সংকল্পে। ‘দিদি’ আর একটি প্যাকেট বার করেন ঝোলা থেকে।
—এটা রেখে দে।
—কী এটা?
—পটাশিয়াম সায়ানাইড।
.
কী আছে এখানে আজ? কোনও হোমরাচোমরা আসছেন? এত পুলিশ কেন?
কলেজ স্ট্রিট চত্বরে সেদিন সকাল থেকেই তুঙ্গ ব্যস্ততা। অন্যদিন বেলা বাড়তে কখনওসখনও দেখা মেলে জোড়াসাঁকো থানার টহলদারি গাড়ির। আজ অন্য ছবি। ভোর থেকেই এলাকায় চক্কর দিচ্ছে পুলিশের একাধিক গাড়ি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোতায়েন সশস্ত্র পুলিশকর্মী। যারা বন্দুক উঁচিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সাদা পোশাকে কিছু বলিষ্ঠ চেহারার লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। সজাগ দৃষ্টি তাঁদের। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, এরা পথচারী নন। প্লেন ড্রেসে পুলিশই। লালবাজারের বড়কর্তারা সরেজমিনে ঘনঘন দেখে যাচ্ছেন পুলিশি ব্যবস্থা।
ব্যাপারটা কী? এত সাজসাজ রব? কেষ্টবিষ্টু আসছেন কোনও? কে?
স্বয়ং বড়লাট! বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল মহামহিম স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আয়োজিত সমাবর্তন উৎসবের প্রধান অতিথি। তিনিই মানপত্র তুলে দেবেন সফল ছাত্রছাত্রীদের হাতে। বহু গণ্যমান্য অতিথির সমাবেশ ঘটতে চলেছে অনুষ্ঠানে। নিরাপত্তা নিয়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে নারাজ কলকাতা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে তৈরি হয়েছে নিশ্ছিদ্র চক্রব্যূহ। মাছিও গলতে পারবে না হাজার চেষ্টা করেও।
কলেজ স্ট্রিটে গাড়ি ঢুকছে একের পর এক, থামছে মূল প্রবেশদ্বারের সামনে। আমন্ত্রিতরা ঢুকছেন। ঢুকছে ছাত্রছাত্রীরাও দল বেঁধে, হইহল্লা করতে করতে। পোশাক আলাদা আজ। রোজকার ধুতি-শার্ট-প্যান্ট বা শাড়ির উপরে আজ কালো গাউন। ডিগ্রি নেওয়ার শুভমুহূর্তের প্রচলিত পরিধান। অন্যরকম সাজে ভারী সুন্দর লাগছে ছেলেমেয়ের দলকে। আজ তো ওদেরই দিন!