‘জায়গা’ বলতে তপসিয়ার কাছে, গাছপালা-ঝোপঝাড়ে ভর্তি ভূখণ্ড। যেখানে কানাইয়ের হাতে রিভলভার তুলে দিয়ে লক্ষ্যভেদের মহড়া নিলেন সুনীল, ‘এই হল তোর চাঁদমারি, চেম্বারে ছ’টা গুলি আছে। মানে চান্স ওই ছ’টা…’
কানাই এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছে, তাকে বাছা হয়েছে কোনও অ্যাকশনের জন্য। সুনীলদা এখনও পুরোটা ভাঙছে না, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর নিয়ে এসেছে আলিপুর কোর্টে। ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে সব, ‘এইটা মুনসেফ কোর্ট, এখানে সাব-জজরা বসেন। এই বড় ঘরটা হল বার লাইব্রেরি। আর এই লম্বা জায়গাটায় টাইপিস্টরা বসেন। সব ভাল করে দেখে রাখ, কোথা দিয়ে ঢুকলাম আর কোন দিক দিয়ে বেরব। বেরনোর আগে সেশন জজের এজলাসটা দেখিয়ে দিই চল। গার্লিক সাহেব যেখানে বসেন।’
গার্লিক সাহেব! শরীরে অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ নিমেষে টের পায় কানাই। সেই গার্লিক, যে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল? সুনীলদার হাত চেপে ধরে কানাই।
—সুনীলদা! তা হলে কি…
সুনীল রাশ টানেন সঙ্গী যুবকের উত্তেজনার।
—বলেছি না উতলা হবি না! ঠান্ডা মাথায় দেখে নে ঘরটা।
ঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রিভলভারধারী সার্জেন্ট। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে একাধিক চিঠি সম্প্রতি পেয়েছেন গার্লিক। সরকার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে এজলাসে। উকিল-মোক্তার বা সাধারণ মানুষ, যে-ই ঢুকছে ঘরে, সার্জেন্টের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আগে জরিপ করে নিচ্ছে আপাদমস্তক। এজলাসে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসেন সুনীল। পাশে কানাই, যে শান্তভাবে তখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ঘরের ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছনে। কয়েকটা তাগড়াই চেহারার লোক জজসাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে। ওরা কারা? সাদা পোশাকের পুলিশ?
শ্রাবণের কলকাতায় তখন বর্ষার একচ্ছত্র দাপট। কোর্ট থেকে ফেরার পথে কানাইয়ের জন্য এক জোড়া ক্যাম্বিসের জুতো কিনলেন সুনীল। ছাতা জয়নগর থেকে নিয়েই এসেছে কানাই। মেসে ফেরা হল যখন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে।
—কানাই… এক কাজ কর.. চট করে মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আয় একবার.. মাসিমা তো এখন তোর দাদার বাড়িতে, না?
—হ্যাঁ।
—বলবি… কলকাতার বাইরে যাচ্ছিস কাজে। ফিরতে দেরি হতে পারে।
রাতের খাওয়া মায়ের কাছেই সারলেন কানাই। অগ্রাহ্য করলেন উদ্বিগ্ন প্রশ্নমালা।
—চিন্তা কোরো না মা .. বললাম তো, বেশি দেরি হলে চিঠি লিখব।
.
মেসে ফেরার পর সব খুলে বললেন সুনীল। কানাই যা আন্দাজ করেছিল, তা-ই। গার্লিক সাহেবকে হত্যা করে দীনেশের ফাঁসির বদলা! কাগজ-কলম বার করে কানাইয়ের হাতে দিলেন সুনীল।
—নে… লেখ…
—কী?
—লেখ… ‘বন্দে মাতরম! ধ্বংস হও; দীনেশ গুপ্তর অবিচারে ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার লও: ইতি—বিমল গুপ্ত।’
—লিখলাম… এর পর?
—এই লেখাটা, মানে চিরকুটটা.. রাখবি ডান পকেটে, আর এই পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্যাকেট বাঁ পকেটে। ছ’ ঘরা এই রিভলভারটা ছাতার মধ্যে। খেয়াল রাখিস, loaded কিন্তু! Suicide squad-এর যে তালিকা পুলিশের কাছে আছে, তাতে কানাইলাল ভট্টাচার্যের নাম নেই। কেউ চেনে না তোকে। এটা অ্যাডভান্টেজ। ভগবান না করুন, যদি তুই পালাতে না পারিস, বিষটা মুখে ফেলে দিবি। পুলিশ তোর পকেটে চিরকুট পাবে, ভাববে, তুই-ই ম্যাজিস্ট্রেট পেডি-র হত্যাকারী পলাতক বিমল দাশগুপ্ত। ভুল ভাঙবে, কিন্তু আসল আততায়ীর হদিশ পাবে না। বুঝলি?
কানাই মাথা নাড়েন, আর সুনীল বলতে থাকেন।
—তুই আগে যাবি, বেরবি বারোটা নাগাদ। আমি একটু পরে যাব ট্যাক্সিতে। একবার উপরে গিয়ে দেখেও আসব তোকে। তারপর নীচে অপেক্ষা করব গাড়িতে। তোকে একটু সাজিয়েও দেব কাল।
.
২৭ জুলাই, ১৯৩১। রণসাজ সম্পূর্ণ কানাইয়ের। নেহাতই গোবেচারা গ্রাম্য যুবকের বেশ। এলোমেলো চুল, কোঁচা-দোলানো হেটো ধুতি আধময়লা। গলা-আঁটা অপরিষ্কার শার্ট। তার উপর কোট। পায়ে নতুন সাদা ক্যাম্বিসের জুতো। হাতে ছাতা, যার মধ্যে গুলিভরা আগ্নেয়াস্ত্র। বেলা বারোটা নাগাদ আলিপুরগামী ট্রামে উঠে বসলেন কানাইলাল ।
সেশনস কোর্টের গাড়িবারান্দার নীচে যখন সুনীল চ্যাটার্জীকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল, ঘড়িতে বেলা একটা। চালক প্রেম সিং বহুদিনের পরিচিত সুনীলের। প্রেম সিং জানে, এঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, বিপজ্জনক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। বাড়তি ঔৎসুক্য দেখায় না কখনও। ডাকলেই চলে আসে, সে দিন হোক বা রাত। আজ যেমন। সুনীলবাবু ডাকতেই অন্য সওয়ারিদের তোয়াক্কা না করে হাজির।
সুনীল উপরে উঠলেন। এজলাসে গার্লিক সাহেব নেই, লাঞ্চে গেছেন। একটু পরেই আসবেন। কানাই সুবোধ বালকের মতো বসে আছে আমজনতার ভিড়ে। সাজ এত নিখুঁত হয়েছে, সন্দেহ করার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি এজলাসের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সার্জেন্ট। সুনীল নেমে আসেন, চড়ে বসেন ট্যাক্সিতে।
—সিংজি… ইঞ্জিন চালু রাখুন… বললেই স্টার্ট দেবেন।
.
কাঁটায় কাঁটায় দুটোয় গার্লিক ফের এলেন এজলাসে। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল সবাই। গার্লিক বসলেন, শুনানি শুরু হল।
—Me Lord… my humble submission before the Learned Court is that…
উকিলের সওয়াল শুনতে শুনতে যখন মাথা নিচু করে একমনে কিছু নোট করছেন গার্লিক, কানাই ঠিক করলেন, এই হল মোক্ষম সময়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তে, এই লোকটা দীনেশ গুপ্তের প্রাণ নিয়েছে, কত বিপ্লবীকে বাধ্য করেছে কারাবাসে, একে খতম করার সুযোগ পাওয়াটাই তো পরম প্রাপ্তি। ক’জন পায়?