বেত মেরে কি ‘মা’ ভোলাবে?
আমি কি মা’র সেই ছেলে?
সুশীল ক্রমে আরও জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কার্যকলাপে। অসমসাহসী কিশোরকে শরিক করা হল কিংসফোর্ড-নিধনের চিত্রনাট্যে। দায়িত্ব পড়ল অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটের বাসস্থানের পারিপার্শ্বিক খুঁটিনাটি সরেজমিনে একাধিকবার দেখে আসার। দেখে তো এলেন, অতঃকিম?
তখন জল্পনা চলছিল প্রশাসনিক মহলে কিছুদিন ধরেই, কলকাতা থেকে বদলি হয়ে যেতে পারেন কিংসফোর্ড। সম্ভাব্য বদলির আগেই শত্রুনিকেশে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছিল প্রভূত সময়ব্যয়ে। প্রয়োগে আর বিলম্ব অনুচিত, সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত।
.
সরকারি চাকুরের কর্মস্থান স্থানান্তরের সময় যা স্বাভাবিক, তুঙ্গে থাকে ব্যস্ততা তল্পিতল্পা গোটানোর। পরবর্তী কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে যোগদানের সময়সীমা থাকে, যা লঙ্ঘিত হলে ঊর্ধ্বতনের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হওয়া অবধারিত। উপস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ গন্তব্যে প্রস্থানই তখন অগ্রাধিকার পায়, বহনযোগ্য গৃহসামগ্রীর সুচারু পারিপাট্য নয়।
কিংসফোর্ড সাহেবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুজফ্ফরপুরে বদলির আদেশ এসেছে। নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সময়াভাবে রওনা দিয়েছিলেন কোনওমতে লটবহর মালবাহী ট্রাকে গচ্ছিত করে।
.
নাশকতামূলক কাজকর্মে আজকাল আকছার ব্যবহৃত হয় Improvised Explosive Devices (IED)। রেডিয়ো, সাইকেল, টিফিনবক্স, হাতঘড়ি, ল্যাপটপ এবং আরও নানাবিধ দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানোর উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। গোপনও কিছু নয়, ইন্টারনেটে মজুত পর্যাপ্ত তথ্যভাণ্ডার।
আলোচ্য ঘটনা একশো বছরেরও বেশি আগের, যখন না ছিল প্রযুক্তির অবাধ আনুকূল্য, না ছিল বহির্জগৎ সম্পর্কে অনায়াস তথ্যস্রোত। সে না-ই বা থাকুক, চিন্তার অভিনবত্ব কবে আর সময়ের আজ্ঞাবহ থেকেছে? বিংশ শতকের প্রথম দশকেই বিপ্লবীরা কিংসফোর্ড হত্যায় প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন IED, তৈরি হয়েছিল বই-বোমা।
কিংসফোর্ডের পুস্তকপ্রীতি সুবিদিত ছিল। বিদায়ী উপহার-উপঢৌকন জমা হবেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কিড স্ট্রিটের বাড়িতে। উপহার হিসাবেই পৌঁছে দেওয়া হবে সুদৃশ্য মোড়কে বই। কিংসফোর্ড খুলবেন, খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে রাখা বোমা ফাটবে সশব্দ তীব্রতায় এবং ঘটবে কার্যসিদ্ধি, এই ছিল হত্যার নীল নকশা।
নকশা রূপায়ণের দায়িত্ব ন্যস্ত হল মেদিনীপুরের বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাসের উপর। হেমচন্দ্র ১৯০৬ সালের জুলাইয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। বিদেশের বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। নানা ধরনের বোমা তৈরির কৌশল শিখলেন ফ্রান্সে। দেশে ফিরলেন ১৯০৭ –এ। সঙ্গে আনলেন ব্রাউনিং পিস্তল আর বোমা বানানোর ম্যানুয়াল। এবং ফিরেই যোগ দিলেন কলকাতায় বারীন ঘোষের গুপ্ত সমিতিতে। দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ণ উদ্যমে। এহেন হেমচন্দ্রের উপরই যে ভার পড়বে বই-বোমা তৈরির, আশ্চর্য কী!
হেমচন্দ্র লেগে পড়লেন কাজে। কোন বইয়ের ভিতর রাখা হবে বোমা? এমন কোনও বই হতে হবে, যা হাতে নিলে কিংসফোর্ডের উৎসাহের উদ্রেক হবে অবধারিত। বাধ্য হবেন পাতা উলটোতে। কী হতে পারে সেই বই? অনেক ভেবে বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, কিংসফোর্ড পেশায় বিচারক, পড়াশুনোর নিয়মিত অভ্যেস রয়েছে, আইনের বই পাঠানোই ভাল।
কী বই? Herbert Broom-এর লেখা ‘Commentaries on the Common Law: Designed as its Introductory to its Study’, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৭৫। হেমচন্দ্র বইয়ের প্রথম ৮০ পাতা আর শেষের প্রায় ৪০০ পাতায় হাত দিলেন না। বাকি প্রায় ৬০০ পাতার প্রত্যেকটি নিপুণ ভাবে কেটে একটি চৌকো খোপ তৈরি করলেন। খোপ তো হল, এবার আসল কাজ। বোমার রসদ ভরা হল ক্যাডবেরি কোকোর কৌটোয়। বিস্ফোরক বোঝাই সেই কৌটো রাখা হল বইয়ের ভিতরের খোপে। হেমচন্দ্র একটি স্প্রিং দিয়ে জুড়লেন বইটিকে। এমন ভাবে জুড়লেন, যাতে কিংসফোর্ড বইটি খোলা মাত্রই স্প্রিং-এর সাহায্যে বোমার রসদ (পিকরিক অ্যাসিড আর ফালমিনেট অফ মার্কারি) সক্রিয় হবে মুহূর্তে, ঘটবে তীব্র বিস্ফোরণ। এবং অতীত হয়ে যাবেন ‘কসাই কাজি’।
বিপ্লবী পরেশ মৌলিক সরকারি কর্মচারীর পরিচয়ে কিংসফোর্ডের বাড়ির সান্ত্রিদের কাছে পৌঁছে দিলেন প্যাকেট। সাহেবের বদলির পর এমন বিদায়-উপহার অনেকই আসছে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করেই প্যাকেট পৌঁছল অন্দরমহলে। সেটা ১৯০৮-এর জানুয়ারি মাস।
কিন্তু বিধি বাম! মাসদুয়েকের মধ্যেই মুজফ্ফরপুরে বদলি হয়ে গেলেন কিংসফোর্ড, জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারপতি হিসাবে। গোছগাছের তাড়াহুড়োয় বইয়ের প্যাকেট খোলাই হল না। ট্রাকবন্দি হয়ে বই-বোমা পাড়ি দিল মুজফ্ফরপুর।
এবং দুর্ভাগ্য বিপ্লবীদের, নতুন কর্মস্থলে পৌঁছেই তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কিংসফোর্ড। বদলির সময় পাওয়া অন্য অনেক উপহারের সঙ্গে বই-বোমাও স্থান পেল বাংলোর আস্তাবলের কাছে একটি গুদামে। কে কী উপহার দিয়েছে, পরে সময়মতো খুলে দেখবেন, এমনটাই ভাবলেন কিংসফোর্ড। আইনের মোটা বইটি পড়ে রইল প্যাকেটসুদ্ধ। খোলা হল না। আয়ুবৃদ্ধি ঘটল সাহেবের।