পাশাপাশি ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলিতে দেশাত্মবোধক নিবন্ধ এতটাই উদ্দীপনা জাগাচ্ছে জনমানসে, প্রভাবে-প্রসারে এতটাই বিস্তার তার দেশপ্রেমী আবেদনের, লেখক এবং প্রকাশক, উভয়ের উপরই নির্বিচারে নেমে আসছে রাজদণ্ড। শাসকের রাজদণ্ড। যা বেশ কিছুকাল আগে, ‘পোহালে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড’ ছেড়ে দেখা দিয়েছিল অকপট।
এখন যেখানে লালবাজারের অবস্থান, তখন তার একটি অংশে ছিল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। যা একাধিক সাড়া-জাগানো মামলার বিচারপর্বের সাক্ষী। ম্যাজিস্ট্রেটের আসনে সে-সময় Douglas Hollinshed Kingsford। উচ্চশিক্ষিত, ট্রিনিটি কলেজের কৃতী ছাত্র। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগদান ১৮৯৪ সালে। একাধিক জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার পর ১৯০৫ সালে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলেন। বঙ্গভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন অল্পদিনেই। সরকারি বাসস্থান শুরুর দিকে ছিল হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে, পরে স্থানান্তরে কিড স্ট্রিটে।
কিংসফোর্ড নিজের মেধা এবং দক্ষতার সিংহভাগ কাজে লাগাতেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি নির্মমতায়। ১৯০৭-এর ২৪ জুলাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই)-কে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। অপরাধ? ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দুটি রচনা প্রকাশ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ বিচারক শাসিত দেশের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন না, প্রত্যাশিত। ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা’-র ‘সমান আঘাতে’ কাঁদার প্রশ্ন নেই, স্বাভাবিকই। কিন্তু কিংসফোর্ড সাহেবের ক্রিয়াকলাপ ছিল নিষ্ঠুরতায় মাত্রাহীন।
মামলা হল ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার বিরুদ্ধেও। অভিযোগ একই, শাসকের শোষণের সোচ্চার বিরুদ্ধাচরণ। সেই মামলার বিচার চলাকালীন অনেকে, অধিকাংশই প্রাণোচ্ছল তরুণ, ভিড় করতেন আদালত চত্বরে। বিপিনচন্দ্র পাল যখন পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করলেন, মামলা নাটকীয় মোড় নিল।
শুনানির দিনগুলিতে হাজারে হাজারে মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করলেন বর্তমানের লালবাজার প্রাঙ্গণে। জনস্রোত আর স্বদেশি স্লোগানের যুগলবন্দি সামলাতে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ প্রায়ই নির্দয় লাঠি চালাতে শুরু করল সাধারণের উপর। নির্বিচার এবং মায়া-মমতাবর্জিত।
দমনপীড়ন সহ্যসীমা অতিক্রম করল ১৯০৭-এর ২৬ অগস্ট। মামলার শুনানি চলছে। বাইরে যথারীতি লোকারণ্য এবং পাল্লা দিয়ে ‘বন্দে মাতরম’-এর নির্ঘোষ। জমায়েত ক্রমশ বাড়ছে কলেবরে। আবেগের লাভাস্রোত নিয়ন্ত্রণে অন্য দিনের মতোই পুলিশ লাঠি চালাল ইনস্পেকটর E B Huey-এর নেতৃত্বে। রুখে দাঁড়াল বছর পনেরোর রোগাসোগা চেহারার এক কিশোর। সুশীল সেন। পালটা কয়েক ঘা দিল ইনস্পেকটরকে। অসম যুদ্ধে নতিস্বীকার করতেই হল সুশীলকে। ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে।
কিংসফোর্ড দেখলেন, শুনলেন এবং বললেন, ‘আরে, এ তো নেহাতই বাচ্চা! একে সবার সামনে পনেরো ঘা বেত মেরে ছেড়ে দাও।’ ১৮৯৯-এর ‘Whipping Act’-এ এমন বেত্রাঘাতের বিধিনিয়ম ছিল।
আদেশ পালিত হল। ইতিহাসবিদদের লেখনীতে চিত্রিত রয়েছে সে দৃশ্য। লালবাজার চত্বরে পনেরো বছরের কিশোরের পিঠে একের পর এক বেতের ঘা আছড়ে পড়ছে। আর প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে জোর বাড়ছে সুশীলের স্লোগানের, ‘বন্দে মাতরম!’ প্রহারের পাশবিকতায় নিষ্ফলা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল স্তম্ভিত জনতা। কিংসফোর্ড মনুষ্যত্বকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন অক্লেশে।
এই নৃশংস ঘটনা তীব্র অভিঘাতের সৃষ্টি করল বাংলা জুড়ে। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডের নাম দিলেন ‘কসাই কাজি’। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো তথাকথিত ‘নরমপন্থী’-রাও সোচ্চার হলেন প্রতিবাদে, আর ‘কট্টরপন্থী’-রা সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘এ অপরাধের ক্ষমা নেই!’ কিংসফোর্ড-হত্যার ছক কষা শুরু হল।
—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায়।
—কী প্ল্যান?
.
সুশীলের জন্ম শিলং-এ, ১৮৯২ সালে। বাবা কৈলাশচন্দ্র সেন ছিলেন শিলং-এর আইজি (কারা)-র কার্যালয়ে প্রধান করণিক। শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা দেশব্যাপী ব্রিটিশ-বিরোধিতার আবহে। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন সুশীল। শিলং-এর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে সিলেটের জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধরের গুপ্ত সংগঠনে যোগ দিলেন। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিলেন বক্সিং আর লাঠিখেলায়। ১৯০৬-এ সিলেটে অনুষ্ঠিত হল সুর্মা ভ্যালি পলিটিক্যাল কনফারেন্স। যেখানে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন ন্যাশনাল স্কুলে। জিমন্যাস্টিক্সের পাঠ নেওয়া শুরু করলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর কাছে।
১৯০৭-এর অগস্টে আদালত প্রাঙ্গণে ঘটল বেত্রাঘাতের ঘটনা। বিপ্লবীদের কাছে রাতারাতি নায়কের মর্যাদায় উন্নীত হলেন সুশীল। সংবর্ধিত হলেন কলেজ স্কোয়ারে। অকুতোভয় কিশোরকে দেখতে উপচে পড়ল ভিড়। এই ঘটনা নিয়ে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ লিখলেন তুমুল জনপ্রিয় হওয়া গান, যা তখন মুখে মুখে ঘুরত বিপ্লবীদের।
(আমার) যায় যাবে জীবন চ’লে আমায়—