সত্যিটা স্বীকার্য, ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী-মাস্টারদা-বাঘা যতীন-প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-বিনয়-বাদল-দীনেশ-এর বাইরেও ছিলেন অশ্রুত-অপঠিত-অকথিত অনেকে, যাঁদের নামই শোনেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ। যাঁদের জন্ম বা মৃত্যুদিনের উদযাপন নেই, নেই আবক্ষমূর্তিতে মাল্যদানের সমারোহ। তাঁদের নিয়েই বই। বই যত না, তার চেয়েও বেশি বোধহয় পূর্বপুরুষের ঋণ শোধের চেষ্টা সীমিত সাধ্যে। যত না বই, তার থেকেও বেশি বোধহয় দায়। পরবর্তী প্রজন্মকে জানানোর দায়, কতটা ত্যাগের মূল্যে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দশটি কাহিনি রয়েছে বইয়ে। যার মধ্যে ন’টিতে রয়েছে বিপ্লবীদের সঙ্গে সেকালের লালবাজারের সম্মুখসমরের আখ্যান। একমাত্র বিনয়-বাদল-দীনেশ ছাড়া বাকি আটটি কাহিনির কুশীলবরা আমপাঠকের অচেনা। বা, চেনা যদিও হয়, সে চেনা ক্ষণস্থায়ী খুচরো আলাপের, গভীর সখ্যের নয়।
একটি কাহিনি, পাঠক লক্ষ করবেন নিশ্চিত, বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। একবারই লালবাজারে বিশ্বকবির পদার্পণের সম্ভাব্য পটভূমি তৈরি হয়েছিল ঘটনার ঘনঘটায়। হোক বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্করহিত, রবীন্দ্রনাথ তো! ‘অচেনা লালবাজার’-এ থাকবেন না, হয়? বরেণ্য দেশনায়কদের নিয়ে ইতিহাসধর্মী গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা নেহাত কম নয় বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু একেবারেই অনামীদের নিয়ে লেখাপত্র চোখে পড়ে না বিশেষ। যদি বা পড়ে, অধিকাংশই হয় ইতিহাসের আপাতনীরস তথ্যস্রোত, নয়তো আবেগের উচ্ছ্বাস।
এ বইয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা থেকেছে আদ্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ থেকেও থ্ৰিলারধর্মিতা বজায় রাখার, যাতে পাঠক ইতিহাসবিমুখতায় আক্রান্ত না হন, অথচ রেশ থেকে যায় স্মৃতিতর্পণের। চেষ্টাই মাত্র। কতটা হয়েছে, আদৌ হয়েছে কিনা, পাঠক বলবেন।
ফেসবুকের পোস্টগুলি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হোক, আন্তরিক ভাবে চেয়েছিলেন কলকাতার নগরপাল শ্রীরাজীব কুমার। আগাগোড়া বলে এসেছেন, ‘পরের প্রজন্মের জানা দরকার, ভীষণভাবে জানা দরকার নাম-না-জানা বিপ্লবীদের এই ত্যাগের খতিয়ান। বই হওয়া দরকার।’ লেখার সময় উৎসাহ জুগিয়েছেন অনিঃশেষ। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তাঁর কাছে। এ বই দিনের আলো দেখল তাঁরই উৎসাহে-উদ্যোগে।
অশেষ ধন্যবাদ কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শ্রীনীহার রায়কে, যিনি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কত যে নথি, কত যে বই অক্লান্ত সরবরাহ করে গিয়েছেন, হিসেব নেই কোনও। অনুজ সহকর্মী ইন্দ্রজিৎ দত্তকে ধন্যবাদ, ম্যানুস্ক্রিপ্ট টাইপই শুধু নয়, লেখকের হাজার বায়নাক্কা হাসিমুখে সামলানোর জন্যও।
ইতিহাস নিয়ে লেখাপত্রে তথ্যপ্রমাদের একটা ভয় থাকেই। যদি থেকে যায় তথ্যের কোনও ভুলভ্রান্তি, দায় শুধুমাত্র লেখকেরই।
‘অচেনা লালবাজার’ পেশ করলাম পাঠকের দরবারে। বাহ্যিক বিচারে বই, আসলে শ্রদ্ধার্ঘ্য।
০১. শুধু নামেই ‘সুশীল’
—আরে, এ যে নেহাতই বাচ্চা! He’s just a child!
—রাইট স্যার, স্টিল মাইনর। কিন্তু তেজ আছে ষোলো আনা। নিষেধ করলেও শুনছিল না। উলটে অফিসারের গায়ে হাত তুলেছে!
—হোয়াট?
—ইয়েস স্যার, ছুটে এসে ধাক্কা দিয়েছে। ঘুসি মেরেছে। সাহসটা ভাবুন একবার! কাস্টডি করে দিই?
—না… জুভেনাইল… কিন্তু হি মাস্ট পে ফর হোয়াট হি হ্যাজ় ডান। Do something, take him downstairs, গুনে গুনে পনেরো ঘা বেত লাগাবেন। Cane him! No less than fifteen times! তারপর ছেড়ে দেবেন।
—রাইট স্যার।
হিড়হিড় করে টানতে টানতে তিনতলা থেকে নীচে নিয়ে যাওয়া হয় একরোখা কিশোরকে। অনুতাপের লেশমাত্র নেই যার চোখেমুখে। বরং ফুঁসছে তখনও।
—এ মেনে নেওয়া যায় না.. কিছুতেই না! একটা বাচ্চা ছেলেকে সবার সামনে ওইভাবে বেত দিয়ে একটার পর একটা..
—হুঁ… মানুষ নয়… নরপশু একটা।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবৃতি
—সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে আন্দোলনের মেরুদণ্ড বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
—মানছি। কিন্তু শিক্ষাটা কী সেটা তো ভাবতে হবে, আর কে কীভাবে দেবে, সেটাও..
—একটাই শিক্ষা হয় ওই অমানুষের। মৃত্যু! বেঁচে থাকার অধিকার নেই আর।
—একমত। কিন্তু চাইলেই তো হল না। সর্বক্ষণ সান্ত্রি-পেয়াদারা ঘিরে রেখেছে। কাছে যাওয়াই মুশকিল। ওই পাহারার মাঝে ওকে মারতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা।
—কিন্তু উপায় তো একটা করতে হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব এর পরও?
—কী উপায়?
—আমার একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে মাথায় …
—কী প্ল্যান?
.
পুরনো সেই দিনের কথা। সূত্রপাত এক শতকেরও বেশি আগে, লালবাজার চত্বরে। দেশ তখনও স্বাদ পায়নি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার। ‘ইউনিয়ন জ্যাক’-কে কক্ষচ্যুত করতে ঢের দেরি আছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার।
বিংশ শতকের প্রথম দশকে বাংলায় স্বদেশি আন্দোলন তখন ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সর্বব্যাপী ক্ষোভ বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করছে অত্যাচারী শাসককে সশস্ত্র আক্রমণে। ‘অনুশীলন সমিতি’ এবং ‘যুগান্তর’-এর মতো গুপ্ত সংগঠনগুলি সক্রিয়তার তুঙ্গে তখন। যে সক্রিয়তায় রাশ টানতে একাধিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে মরিয়া ব্রিটিশ প্রশাসন।