মোটিভের অংশটি অবশ্য সহজসাধ্যই ছিল। অমরেন্দ্রর মৃত্যুতে বিনয়েন্দ্র যে লাভবান হতেন, সেটা তো জলবৎ তরলং ছিল। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ একত্রিত করার দুরূহ কাজটি সুসম্পন্ন করতে প্রাণপাত করেছিলেন কলকাতার গোয়েন্দারা। বিনয়েন্দ্রর বোম্বাইযাত্রার দিনপঞ্জি এবং হোটেলবাসের প্রতিটি নথি জোগাড়, রেজিস্টারের হস্তাক্ষরের সঙ্গে অভিযুক্তের হস্তাক্ষর মেলানো, হফকিন ইনস্টিটিউটে যাতায়াতের প্রমাণ সংগ্রহ, তারানাথের টেলিগ্রাম এবং ডা. ভট্টাচার্যের সুপারিশপত্র, যে দোকান থেকে ইঁদুর কেনা হয়েছিল সেটি খুঁজে বের করে মালিকের জবানবন্দি, যে ট্যাক্সিতে করে বোম্বাইয়ের প্লেগ হসপিটালে পৌঁছেছিলেন তারানাথ, সেটিকে খুঁজে বের করা, পুঙ্খানুপুঙ্খ এমন আরও যে কত, লিখলে তালিকা দীর্ঘতর হতে থাকবে। বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দরাজ সাহায্যের, নিয়মিত কলকাতার নগরপালের সঙ্গে আলোচনা করতেন তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে।
বিচারপর্বে অঢেল অর্থব্যয় করবেন বিনয়েন্দ্র, প্রত্যাশিতই ছিল | লাভ হয়নি যদিও। নিম্ন আদালত ফাঁসির আদেশ দেয় বিনয়েন্দ্র ও তারানাথকে। মুক্তি দেওয়া হয় ডা. ধর এবং ডা. ভট্টাচার্যকে। উচ্চ আদালতে আপিল পেশ হয় যথানিয়মে। ফাঁসির আদেশ কমে সাজা হয় ‘কালাপানির’, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। বিচারক লেখেন রায়ে, “probably unique in the annals of crime।”
মামলার নথিপত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে খুনের প্রস্তুতিপর্বে তারানাথকে ষড়যন্ত্রী আশ্বাস বিনয়েন্দ্রর, কেউ জানবে না, কে পিন ফুটিয়েছিল। খুনিই না পেলে পুলিশ কাঁচকলা করবে! সহজ হিসেব।
সহজ? সহজ আর থাকল কই? প্রেক্ষিত আলাদা, ব্যঞ্জনাও বহুমাত্রিক। তবু, এ কাহিনির উপসংহারে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন ঝলকে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত—
“এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।”
১.০২ মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো
[বেলারানী হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ]
দৃশ্য-১
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ভোর সোয়া পাঁচটা, বড়জোর সাড়ে পাঁচ।
ভোর হয়েছে, সকাল নয়। রাসবিহারী থেকে চেতলার দিকে যেতে ডানহাতে কালীঘাটের বাস্তুহারা বাজার। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলতে খুলতে সে আরও অন্তত কয়েক ঘণ্টা। বাজারের সাফাইকর্মীদের বেশির ভাগই অবশ্য উঠে পড়েন দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই। বেলা একটু বাড়লেই মেলা লেগে যাবে লোকের। আগে থেকে সাফসুতরো করে না রাখলে পরে সামলে ওঠা দায়।
এমনই একজন কর্মীর প্রথম চোখে পড়ল কাগজের মোড়কগুলো। তিনটে পাশাপাশি। পড়ে রয়েছে কেওড়াতলা শ্মশানের কাছে একটি শৌচালয়ের পাশে। সে তো কত কিছুই এদিকে-ওদিকে পড়ে থাকে, কিন্তু এ তো অন্যরকম! প্রথম দর্শনেই আঁতকে ওঠার মতো। নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা কাগজের মোড়কগুলোর একটার কিছু অংশ ছিঁড়ে গিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের লালচে ছোপ কাগজে। ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো আঙুল। ডাক্তারবদ্যি হওয়ার প্রয়োজন নেই, এক ঝলকেই বোঝা যায়, আঙুল মনুষ্যদেহের।
আতঙ্কিত চিৎকার-চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হল দ্রুত। খবর গেল টালিগঞ্জ থানায়। অফিসাররা এসে কৌতূহলী ভিড় সরালেন প্রথমে, খোলা হল মোড়ক। একের পর দুই, দুয়ের পর তিন। বেরোল দুটো হাতের টুকরো টুকরো খণ্ড। বাহুমূল থেকে কনুই। কনুই থেকে আঙুল। ছিন্নভিন্ন। কাগজের মোড়কটি দেখা হল খুঁটিয়ে। ২১ নভেম্বরের ‘যুগান্তর’।
দৃশ্য-২
৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ভরদুপুর।
সবে খেয়ে উঠেছেন কালীঘাট পার্কের বহুদিনের দারোয়ান। শীতের ঝিমধরা দুপুরে ইতস্তত ঘুরছেন গাছগাছালিতে ঘেরা উদ্যানের এদিক-সেদিক, রোজকার অভ্যাসমতো। ঘুরতে ঘুরতেই চোখ আটকে গেল একটা আমগাছের পিছনে। ঝোপঝাড়-আগাছার জঙ্গলে কী পড়ে আছে ওগুলো? চারটে কাগজের মোড়ক, বাঁধা ওই নারকেল দড়ি দিয়েই। কৌতূহলবশত খুলেই ফেললেন। ভিতরে যা দেখলেন, ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটাছুটি করে এরপর শ’খানেক পথচলতি মানুষের ভিড় জুটিয়ে ফেলতে লাগল খুব বেশি হলে মিনিটদুয়েক।
একটি মোড়কে হাঁটু থেকে কাটা দুটি পায়ের অংশ। দ্বিতীয়টিতে নারীশরীরের উপরিভাগ ত্রিখণ্ডিত অবস্থায়। তিন নম্বর মোড়কে ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া মাথা। নাক-কান-ঠোঁট-চুল বিহীন। মুখের চামড়া চেঁছে তুলে নেওয়া হয়েছে। আঘাতের তীব্রতায় চূড়ান্ত বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে মুখাবয়ব। কয়েকগাছি চুল, মাত্র কয়েকগাছিই, লেগে রয়েছে কপালের উপরে।
শেষ মোড়কটিতে মিলল একটি ভ্রূণ। যাতে চোখ বুলোলেই মালুম হয়, পৃথিবীর আলো দেখার আর বেশি দেরি ছিল না। মৃতা সন্তানসম্ভবা ছিলেন, প্রসবমুহূর্ত এসেই গিয়েছিল প্রায়।
ফের থানাপুলিশ। খবর পেয়েই টালিগঞ্জ থানার অফিসাররা ছুটলেন ঊর্ধ্বশ্বাসে, সকালের উদ্ধার হওয়া দেহাংশ নিয়ে ধন্দ তখনও কাটেনি। লালবাজার থেকেও হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দাদের নিয়ে গাড়ি ছুটল। গন্তব্য, লেখা বাহুল্য, কালীঘাট পার্ক।
চারটি মোড়কই দেখা গেল ‘যুগান্তর’-এর। ২১ নভেম্বর, ১৯৫৩, ১০ জানুয়ারি, ১৯৫৪, ২৫ জানুয়ারি ও ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫৪।
পার্কের চিরুনিতল্লাশিতে পাওয়া গেল আরও একটি মোড়ক। রাখা ছিল একটি বালির বস্তার নীচে। যার ভিতর থেকে বেরল দুই ঊরুর টুকরো টুকরো অংশ।