ডা. এন আর সেনগুপ্তকে পাঠানো সাক্ষীদানের সমন
১৬ ফেব্রুয়ারি ট্রপিক্যাল মেডিসিনের রিপোর্ট আসামাত্রই কমলাপ্রসাদ টালিগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন। পাঁচজন অভিযুক্ত। বিনয়েন্দ্রচন্দ্র পান্ডে, ডাক্তার তারানাথ ভট্টাচার্য, ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য, ডাক্তার দুর্গারতন ধর এবং সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, যে স্টেশনে পিন ফুটিয়েছিল।
FIR হয়েছে খবর পাওয়ামাত্র পালালেন বিনয়েন্দ্র। পালিয়ে যাবেন কোথায়, নজরদারি তো ছিলই অষ্টপ্রহর। গ্রেফতার করা হল সে-রাতেই। আসানসোল স্টেশনে, ট্রেনের কামরা থেকে। ডা. ধর ধরা পড়লেন পরের দিন, তারানাথ আরও একদিন পরে। ১৮ ফেব্রুয়ারির সকালে। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য মাসখানেক পর, ২৪ মার্চ।
কিন্তু যে লোকটি পিন ফুটিয়েছিল? বেঁটে, কালো, খদ্দরের চাদরমুড়ি দেওয়া অপরিচিত? বিনয়েন্দ্র স্বীকার করলেন, তিনিই লোকটাকে পূর্ণ থিয়েটারে পাঠিয়েছিলেন অমরেন্দ্রকে চিনে নিতে। কিন্তু লোকটির নাম-ঠিকানা এক-একবার এক-একরকম বলে চললেন, কোথাও খোঁজ মিলল না হাজার চেষ্টাতেও। ছবি-টবি আঁকিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার পরেও না।
দুটো সম্ভাবনা ছিল। এক, প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে আততায়ীকে চলে যেতে বলেছিলেন বিনয়েন্দ্র ভিনরাজ্যের কোনও প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখান থেকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। দুই, ঘটনার পর বিনয়েন্দ্রই লোক লাগিয়ে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছিলেন আততায়ীকে। যাতে ভবিষ্যতে ব্ল্যাকমেলের আশঙ্কাও নির্মূল করে দেওয়া যায় চিরতরে। দ্বিতীয়টাই সম্ভবত ঘটেছিল, ধারণা হয়েছিল তদন্তকারীদের।
জিজ্ঞাসাবাদে অমরেন্দ্র-হত্যার পরিকল্পনা যা জানা গেল, তা ঘোর লজ্জায় ফেলে দেবে যে-কোনও রুদ্ধশ্বাস গোয়েন্দা কাহিনিকে। ভাবুন একবার, প্রায় এক শতক আগে স্থির মস্তিষ্কে এক বছর তিরিশের যুবক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে ভাইকে খুনের প্ল্যান করছে! শরদিন্দুর উপন্যাসে সাইকেল থেকে নিক্ষিপ্ত গ্রামোফোন পিন বা শজারুর কাঁটা দিয়ে খুনের কাহিনি বহুপঠিত। বাস্তবের বিনয়েন্দ্রর কুকর্মের অভিনবত্ব তুলনায় ঢের বেশি কূটবুদ্ধির, সন্দেহ নেই কোনও।
সম্পত্তির ন্যায্য প্রাপ্য অমরেন্দ্র দাবি করার দিন থেকেই বিনয়েন্দ্র ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন ভাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার। নাকে আঁটা চশমার মাধ্যমে Tetanus সংক্রমণের চেষ্টা যখন ব্যর্থ হল, তখন আরও প্রাণঘাতী কিছুর সন্ধানে মনোযোগী হলেন বিনয়েন্দ্র। ষড়যন্ত্রের শরিক হলেন তারানাথ। যিনি আদপে ডাক্তারই নন (ভুয়ো ডাক্তার সে-যুগেও ছিল!)। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ‘Calcutta Medical Supply Concern’ নামে এক ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। সেই সুবাদে অসুখবিসুখ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়েছিল। তারানাথই বুদ্ধি দিলেন, ঘাতক হিসাবে প্লেগ অব্যর্থ।
কিন্তু ভাবলেই তো হল না, প্রয়োগের উপায়? তার চেয়েও জরুরি, প্লেগের bacilli পাওয়া যাবে কোথা থেকে? কে দেবে? বোম্বাইয়ের হফকিন ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হল।
‘Haffkine Institute for Training, Research and Testing’ স্থাপিত হয়েছিল ১৮৯৯ সালে, বোম্বাইয়ের পারেল অঞ্চলে। প্রতিষ্ঠাতা Dr Waldemar Mordecal Haffkine শুরুতে নাম রেখেছিলেন ‘Plague Research Laboratory’। তারানাথ টেলিগ্রাম করে ইনস্টিটিউটে জানালেন, তাঁর ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ডিপ্লোমা রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া-বাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন, plague bacilli প্রয়োজন। ইনস্টিটিউট উত্তরে জানাল, কলকাতার surgeon general –এর সুপারিশ পাঠালে বিবেচনা করে দেখা হবে আর্জি। কিন্তু কে দেবে অজ্ঞাতকুলশীল তারানাথকে ওই মহার্ঘ সুপারিশপত্র, আর কেনই বা দেবে?
তা হলে? ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য ও ডা. দুর্গারতন ধরের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করলেন বিনয়েন্দ্র-তারানাথ। যথেষ্ট অর্থের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দুই চিকিৎসকও যোগ দিলেন প্লেগ-পরিকল্পনায়। ডা. ভট্টাচার্য দীর্ঘ সুপারিশ পাঠালেন তারানাথের হয়ে। উত্তর এল নেতিবাচক।
বিনয়েন্দ্র তবু অদম্য, একাধিকবার বোম্বাই গেলেন। সরকারিভাবে সুবিধে করতে পারলেন না। মরিয়া চেষ্টায় ইনস্টিটিউটের দুই ডাক্তারকে বিপুল অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখালেন লাগাতার। বিলাসবহুল Sea View Hotel-এ ব্যবস্থা করলেন যথেচ্ছ বিনোদনের, দিনের পর দিন। দুই ডাক্তার প্রলোভনে নতিস্বীকার করলেন শেষমেশ, কিন্তু লিখিত প্রমাণ রাখলেন না। সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে বিনয়েন্দ্র-তারানাথের কাছে পৌঁছল ‘লাইভ প্লেগ কালচারের’ vial। সেটা ৭ জুলাই, ১৯৩৩। তারানাথকে সুযোগ করে দেওয়া হল বোম্বাইয়ের প্লেগ হসপিটালে ‘bacteriologist’ পরিচয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার। সাদা ইঁদুরের উপর ব্যাকটেরিয়া-বিষ প্রয়োগ করে নিশ্চিত হলেন তারানাথ।
এরপর যা ঘটেছিল, লিখেছি আগেই। কুড়ি বছরের যুবকের দেহে প্লেগ bacilli ঢুকিয়ে বিরলতম হত্যা। যা হইচই ফেলে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচলে।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর, দাবিই করা যাক, অসামান্য তদন্ত করেছিল। যা মুক্তকণ্ঠে তারিফ করেছিলেন জজসাহেব তাঁর রায়ে। তদন্তকারী অফিসার শুরুর দিকে ছিলেন সাব ইনস্পেকটর শরৎচন্দ্র মিত্র, পরে ইনস্পেকটর এম এল রহমান। আততায়ীকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। এমন অবস্থায় বাকি ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তিদান নিশ্চিত করতে ভরসা শুধু অকাট্য যুক্তিতে মোটিভকে প্রমাণ করা এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণের (circumstantial evidence) জালটি এমন ভাবে বোনা যাতে ঘটনাপরম্পরার গতিপথ (chain of events) দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। এ কাজ যে কী ভীষণ কষ্টসাধ্য, সে তদন্তকারী অফিসারই শুধু জানেন।