পাঞ্জাবির হাতা তুলে অমরেন্দ্র দেখালেন ক্ষতচিহ্ন। আপাতদৃষ্টিতে মারাত্মক কিছু নয়। কিছুটা তরল পদার্থ পিন ফোটানোর জায়গা থেকে চুঁইয়ে পড়েছে পাঞ্জাবিতে। ট্রেন ছাড়তে তখন বাকি মিনিট পাঁচেক। সহোদরা বনবালা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অমরেন্দ্রর বন্ধু কমলাপ্রসাদ এবং অন্যরাও। বললেন, ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া যাক। দু’দিন পরই না হয় পাকুড় যাওয়া যাবে। বিনয়েন্দ্রও কপট উদ্বেগ দেখালেন প্রাথমিক, তারপর বললেন, ‘এ তো সামান্য ব্যাপার, পাকুড়ে গিয়েও তো ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া যায়।’ কমলাপ্রসাদ প্রতিবাদ করতে গেলে বিনয়েন্দ্র মেজাজ হারালেন, ‘আমরা পাকুড়ের জমিদারবাড়ির। এসব তুচ্ছ ব্যাপারে তোমরা সাধারণরা মাথা ঘামাতে পারো। আমরা নয়।’
অমরেন্দ্রর কিছু জরুরি কাজও ছিল পরের দু’দিনে। ভাবলেন, ডাক্তার দেখিয়ে নেব বাড়ি ফিরে। বনবালাকে নিয়ে উঠে বসলেন পাকুড়গামী ট্রেনে। এবং মারাত্মক ভুল করলেন।
ভাইবোন যখন ট্রেনে বিকেলের জলযোগ সারছেন, কথোপকথন হল এইরকম।
—দাদাভাই, আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।
—কেন রে?
—না, ওই পিন ফোটানোর ব্যাপারটা । মনটা খচখচ করছে।
—ও কিছু না। পকেটমার-টার হবে। ছোট ক্ষুরটুর ছিল হয়তো হাতে।
—ক্ষুরে অমন দাগ হয়? আমি লোকটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি, মনে করতে পারছি না কিছুতেই …
—যাহ্, কী যে বলিস। তুই আবার কোথায় দেখলি?
—না রে, দেখেছি কোথাও, একদম এক চেহারা।
—চেহারাটা তো আমিও দেখলাম। বেঁটে, মিশকালো, গায়ে খদ্দরের চাদর ছিল। পায়ে চপ্পল।
—দাদাভাই! মনে পড়েছে! আমরা গত সপ্তাহে যখন পূর্ণ থিয়েটারে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম, ওই লোকটা টিকিট কাউন্টারের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল।
—আরে ধুর। তোর মনের ভুল। বেশি ভাবিস না তো।
বনবালার আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা বোঝা গেল পরের দিন থেকেই। প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়লেন অমরেন্দ্র। ২৮ তারিখ রাতে ফিরিয়ে আনা হল কলকাতায়। এবার উঠলেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের একটা ভাড়াবাড়িতে। ডাকা হল আর এক প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসককে। ডা. নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্ত। অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবু ‘ব্লাড কালচার’ করতে বললেন অবিলম্বে। ডান দিকের বাহুমূল ততক্ষণে ফুলে উঠেছে অমরেন্দ্রর। জ্বর নামছেই না ১০৫ ডিগ্রির নীচে। কষ্ট পাচ্ছেন প্রচণ্ড। রক্তচাপ হোক বা হৃদ্স্পন্দন, প্রতি ঘণ্টায় একটু একটু করে চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অমরেন্দ্র জ্ঞান হারালেন, ৪ ডিসেম্বর সকালে প্রাণ। ‘ব্লাড কালচার’-এর রিপোর্ট এল পরদিন। যার সারাংশ পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ডাক্তাররা। মৃতের রক্তে ‘Pasteurella Pestis’ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। যা শরীরে ঢুকলে plague-এ আক্রান্ত হওয়া অনিবার্য। প্লেগের মারণছোবলেই প্রাণনাশ অমরেন্দ্রর, সংশয়ের অবকাশ নেই তিলমাত্র।
রোগভোগে আপাত-স্বাভাবিক মৃত্যু। ময়নাতদন্ত হল না, দাহ হল নিয়মমাফিক। মুখাগ্নি করলেন বিনয়েন্দ্র, কেঁদে ভাসালেন। ওই কুনাট্য সহ্য করতে হল অমরেন্দ্রর ঘনিষ্ঠদের। যাঁদের আগাগোড়াই সন্দেহ ছিল বিনয়েন্দ্রর উপর। পিন ফোটানোর ঘটনা নিশ্চয়ই বিনয়েন্দ্ররই মস্তিষ্কপ্রসূত, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অমরেন্দ্রর বন্ধুদের। কিন্তু প্রমাণ কই? সন্দেহের বশে তো আর কাউকে ফাঁসিকাঠে চড়ানো যায় না।
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা এক যুবকের অকালমৃত্যু, তা-ও প্লেগে! চিন্তায় পড়ে গেলেন কলকাতার চিকিৎসকমহল। দিকপাল ডাক্তাররা শেষ সময়ে চিকিৎসা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন অমরেন্দ্রর আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে, নথিবন্দি করেছিলেন দিনকয়েক আগের পিন ফোটার ঘটনা এবং পরবর্তী সমস্ত রোগলক্ষণ। গোলমাল আছে কিছু, চিকিৎসকদল আন্দাজ করেছিলেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়।
ডাক্তাররা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ১২ ফেব্রুয়ারি একঝাঁক প্রশ্ন পাঠালেন ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিরেক্টরের কাছে। প্লেগের ‘bacilli’ কি হাইপোডারমিক নিডলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো যায়? গেলে কত পরিমাণে? যতটা যায়, ততটা কি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট? এ ছাড়া আরও বেশ কিছু, টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি। বিস্তারিত উত্তর এল চার দিন পর, ১৬ তারিখ। বলা হল, এই মৃত্যু অস্বাভাবিক, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটানো হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে এ জিনিস ঘটেনি। অতএব, ‘homicidal death’— খুন! এবং যে ‘bacilli’-ঘটিত মৃত্যু, তা কলকাতায় পাওয়া যায় না। একমাত্র বোম্বাইতেই (সেসময়ের নামটাই রাখলাম বাণিজ্যনগরীর) মেলে Haffkine Institute-এ।
অমরেন্দ্রর বন্ধুরা কিন্তু হাল ছাড়েননি দাহকার্য সাঙ্গ হওয়ার পরও। ট্রপিক্যালের রিপোর্ট আসার একমাস আগেই ঘটনার সবিস্তার বিবরণ সমেত কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পাকুড় জমিদারবাড়ির পারিবারিক উকিল। অভিযোগ দায়ের করার মতো নথিপত্র ছিল না হাতে। তাই কেস নথিবদ্ধ করা হয়নি তখনও, কিন্তু পুলিশের গোপন অনুসন্ধান এবং নজরদারি চালু হয়েছিল বিনয়েন্দ্র এবং তারানাথের গতিবিধির উপর। গোয়েন্দারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন প্রাক্-মৃত্যু চিকিৎসা যাঁরা করেছিলেন, সেই ডাক্তারদের সঙ্গে। অলিখিত তদন্ত একরকম শুরুই হয়ে গিয়েছিল।