নাকে চাপটা কি একটু বেশিই দিয়েছিল দাদা? একটু খটকা যে লাগেনি অমরেন্দ্রর, এমনটা নয়। বন্ধুদের জানিয়েওছিলেন, বলেছিলেন সূর্যবতীকেও। সকলেই কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করেছিলেন শুনে। অস্বস্তি আশঙ্কায় পরিণত হল, যখন দিন তিনেক পরে মুখের একটি দিক ফুলে গিয়ে প্রায় অবশ হয়ে গেল অমরেন্দ্রর।
বিনয়েন্দ্র তার আগেই ফিরে এসেছেন কলকাতায়। পারিবারিক চিকিৎসককে খবর দেওয়া হল। তিনি দেখেশুনে বললেন, টিটেনাসের সংক্রমণ। Anti-tetanus প্রতিষেধক চালু হল প্রথামাফিক।
চিকিৎসা চলাকালীনই বিনয়েন্দ্র দেওঘরে পাঠালেন তাঁর পরিচিত এক তরুণ ডাক্তারকে। নাম তারানাথ ভট্টাচার্য, কথাবার্তায় চৌকস। এসেই প্রস্তাব দিলেন মরফিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার। ততদিনে দেওঘরের একাধিক চিকিৎসক দিনরাত পর্যবেক্ষণে রেখেছেন অসুস্থ অমরেন্দ্রকে। কেউই মানলেন না তারানাথের পরামর্শ।
বিনয়েন্দ্র ছিলেন গভীরতম জলের মাছ। নিজেই চলে এলেন দেওঘর, সঙ্গে তুলনায় অভিজ্ঞ এক চিকিৎসক, ডাক্তার দুর্গারতন ধর। যিনি চিকিৎসাবিদ্যার ব্যাপারে প্রভূত জ্ঞান বিতরণ করে চিকিৎসকদের রাজি করিয়ে ফেললেন একটি ইঞ্জেকশন দিতে। যেটি নিজেই সঙ্গে করে এনেছেন কলকাতা থেকে। দেওয়া হল ইঞ্জেকশন।
কলকাতায় রোগী দেখার জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে ডা. ধর আধঘণ্টা পরে কলকাতার ট্রেন ধরলেন। সঙ্গী বিনয়েন্দ্রও। এদিকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই আচমকা দ্রুত শারীরিক অবনতি হতে শুরু করল অমরেন্দ্রর। প্রায় অচৈতন্য, রক্তচাপ যখন-তখন অগ্রাহ্য করছে বিপদসীমা। ‘এই যায় সেই যায়’ অবস্থা। সে যাত্রা কোনওক্রমে সামাল দিলেন ডাক্তাররা।
কয়েকদিন পর বিনয়েন্দ্র ফের উদয় হলেন দেওঘরে, ভাই কেমন আছে দেখার অছিলায়। সঙ্গে এবারও সেই ডাক্তার ধর এবং আরও একজন। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য। ঢের শিক্ষা হয়েছে ততদিনে অমরেন্দ্রর বন্ধুবান্ধব-শুভানুধ্যায়ীদের। সূর্যবতীও কড়া নির্দেশ জারি করেছেন বিনয়েন্দ্রকে দেওঘরের বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার। দেওয়া হলও না। নিষ্ফলা বাদানুবাদের পর বিনয়েন্দ্র দুই সঙ্গী-চিকিৎসক সহ ফিরে গেলেন কলকাতায়।
অমরেন্দ্রর শরীরস্বাস্থ্য চিন্তায় ফেলল সূর্যবতীকে। যে ছেলের ছোটবেলার অভ্যেস ভোর পাঁচটায় উঠে শরীরচর্চার, সে বেলা দশটার আগে এখন বিছানাই ছাড়তে পারে না দুর্বলতার জেরে। বছর ঘুরে তখন ১৯৩৩। অমরেন্দ্রকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল সুচিকিৎসার প্রয়োজনে। হরিশ মুখার্জি রোডের একটি বিশাল বাড়ি ভাড়া করা হল। খবর দেওয়া হল সেই কিংবদন্তি চিকিৎসককে, যাঁর নামে কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডা. নীলরতন সরকার রোগী দেখে ওষুধপত্র দিলেন। সঙ্গে পরামর্শ, কিছুদিন কাজকর্মের চিন্তা সম্পূর্ণ দূরে রেখে বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসার।
অমরেন্দ্র ‘চেঞ্জে’ গেলেন ভুবনেশ্বরে, কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হল না। মাথা ঘোরে, অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। খিদে কমে গিয়েছে। বই পড়তে ভালবাসতেন খুব, সে ইচ্ছেও যেতে বসেছে। বন্ধুরা নতুন বই পাঠালে দু’-চার পাতা উলটেই রেখে দেন। মাসকয়েক পর ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে এলেন পাকুড়ে। ভগ্ন শরীরেই জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা শুরু করলেন সাধ্যমতো।
বিনয়েন্দ্র এ সময়টা শান্তশিষ্ট দিনযাপন করছিলেন, ভাবার কারণ নেই কোনও। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, ছকেরও না। চক্রান্তের শেষ অঙ্ক অভিনীত হল ’৩৩ -এর নভেম্বরে। ১৮ তারিখ পাকুড়ের বাড়িতে সূর্যবতীদেবীর টেলিগ্রাম এল অমরেন্দ্রর নামে, ‘কলকাতায় শীঘ্র আসিও। রাজস্ব-সংক্রান্ত আইনি আলোচনা রহিয়াছে।’
পত্রপাঠ কলকাতা রওনা দিলেন অমরেন্দ্র এবং গিয়ে আবিষ্কার করলেন, টেলিগ্রামটি ভুয়ো। সূর্যবতী আদৌ আসেননি কলকাতায়। তারবার্তাটি তাঁর নয়।
অমরেন্দ্র সব জানালেন সূর্যবতীকে। দু’জনেই সহমত হলেন, এ অপকর্ম বিনয়েন্দ্রর। জ্যাঠাইমা সূর্যবতী আদরের ‘বাবু’-কে সতর্ক করে দিলেন, ‘কাছেপিঠে ঘেঁষতে দিবি না দাদাকে।’ অমরেন্দ্র সরাসরি জানতে চাইলেন দাদার কাছে টেলিগ্রামের ব্যাপারে। বিনয়েন্দ্র অম্লানবদনে অস্বীকার করলেন। এরই মধ্যে বিনয়েন্দ্র একাধিকবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন দুই পুত্রের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে প্রতাপেন্দ্রর রেখে যাওয়া দু’লাখ টাকার সিংহভাগ অমরেন্দ্রর অজ্ঞাতে সই জাল করে তুলে নেওয়ার। সবই জানতে পেরেছিলেন অমরেন্দ্র পারিবারিক উকিলের মাধ্যমে। সে নিয়েও বচসা হল খানিক।
২৫ নভেম্বর, ১৯৩৩। পরের দিন অমরেন্দ্রর কলকাতা থেকে পাকুড়ে ফিরে যাওয়ার কথা দুপুরের ট্রেনে। সন্ধেবেলা অমরেন্দ্রর কলকাতার অস্থায়ী বাসস্থানে এসে হাজির বিনয়েন্দ্র। সব তিক্ততা ভুলে গিয়ে হঠাৎই যেন স্নেহশীল বড়দার ভূমিকায়। কথায় কথায় স্মৃতিচারণ করছেন শৈশব-কৈশোরের, কিঞ্চিৎ ঘনঘনই গলা বুজে আসছে কান্নায়, ‘তুই আমাকে ভুল বুঝিস না বাবু, শরীরের যত্ন নিস ভাই।’
অমরেন্দ্র দাদার চরিত্র জানতেন, কুম্ভীরাশ্রুতে বিচলিত হওয়ার কারণ দেখলেন না কোনও। বিনয়েন্দ্র যাওয়ার আগে কথায় কথায় জেনে নিলেন, পরদিন ভাইয়ের ট্রেন কখন।
২৬ নভেম্বর। স্টেশনে অমরেন্দ্র এবং আত্মীয়বান্ধবরা একটু অবাকই সহাস্য বিনয়েন্দ্রকে দেখে। কেউ কেউ বললেনও, এ আপদ এখানে কেন? অমরেন্দ্র নিরস্ত করলেন উত্তেজিত স্বজনদের। যতই কুচক্রী হোন, বৈমাত্রেয় হলেও দাদা তো! স্টেশনে এসেছেন, ও ভাবে বিদেয় করে দেওয়া যায়? এর কিছু পরে অতর্কিতে উলটোদিক থেকে খদ্দরের চাদরমুড়ি অপরিচিতের দ্রুত ধাক্কা দিয়ে অন্তর্ধান, গাড়ি ছাড়ার পূর্বমুহূর্তের সে ঘটনা বলেছি শুরুতে।