ট্রেন ছাড়ব-ছাড়ব করছে, অমরেন্দ্র-বনবালাকে ঘিরে জটলা। বিদায়-সম্ভাষণের পালা চলছে। হঠাৎই উলটো দিক থেকে একটি লোক, গায়ে খদ্দরের ময়লা চাদর, দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে অমরেন্দ্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে, কেউ কিছু বোঝার আগেই নিমেষে মিলিয়ে গেল ভিড়ে। আর অমরেন্দ্রর মুখ থেকে ছিটকে বেরল যন্ত্রণা, উফফ, কী একটা ফুটিয়ে দিয়ে চলে গেল!
আজ যে মামলার কথা, যখনকার কথা, পাঠক-পাঠিকাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্মই হয়নি, নিশ্চিত। প্রায় পঁচাশি বছর আগের ঘটনা এই মামলা বিরলতমের পর্যায়ভুক্ত। আজও আলোচিত হয় দেশ-বিদেশের অপরাধ-বিষয়ক লেখালেখিতে, গবেষণায়। বলা হয়, “One of the first cases of individual bioterrorism in modern world history.” কী বাংলা হয়? জীবাণু-অস্ত্রে ব্যক্তিহত্যা? জুতসই হল না মোটেই। না হোক, ঘটনার বিবরণে আসি, যা পড়লে মনে হতে বাধ্য, এভাবেও মেরে ফেলা যায়!
পাকুড় হত্যা মামলা। টালিগঞ্জ থানা, কেস নম্বর ৬৭। ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির তারিখ ১৭/২/৩৪। ৩০২/১২০ বি। খুন এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। অনেকে শুনেছেন এই মামলার কথা, বিস্তর লেখাও হয়েছে এ নিয়ে। ইন্টারনেটেও পাবেন। তবে অধিকাংশ বিবরণেই নানা ভাষা-নানা মত-নানা অনুমান। বিভ্রান্তির অবকাশ অনেক। রইল প্রামাণ্য ঘটনাপ্রবাহ, কেস ডায়েরি থেকে, সযত্নে যা রক্ষিত আছে উত্তর কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে আমাদের সংগ্রহশালায়।
পাকুড় মামলার চার্জশিটের প্রতিলিপি
পাকুড়ের অবস্থান ঝাড়খণ্ডের উত্তর-পূর্বে। সাঁওতাল পরগনায়। বহুদিন সাহেবগঞ্জ জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল ছিল। স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা মিলেছে ’৯৪-এ। দেশের মানচিত্রে পাকুড় বিখ্যাত ব্ল্যাকস্টোনের জন্য। উত্তরে সাহেবগঞ্জ, দক্ষিণে দুমকা, পশ্চিমে গোদ্দা জেলা আর পূর্বে আমাদের মুর্শিদাবাদ-বীরভূম। প্রাক-স্বাধীনতা আমলে দেশের অন্যতম ধনাঢ্য জমিদারির মালিকানা ছিল পাকুড়ের পান্ডে পরিবারের। সমসময়ের বংশলতিকার যেটুকু প্রয়োজন কাহিনির স্বার্থে, বলে নিই।
কুমার প্রতাপেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের দুই স্ত্রী ছিলেন। দু’জনেই পরলোকগতা। প্রথম পক্ষের পুত্র বিনয়েন্দ্র, কন্যা কাননবালা। এক পুত্র, এক কন্যা দ্বিতীয় পক্ষেও। অমরেন্দ্র আর বনবালা। প্রতাপেন্দ্রর দাদা গত হয়েছেন, যাঁর নিঃসন্তান স্ত্রী বর্তমান। রানি সূর্যবতীদেবী। অমরেন্দ্রর মাতৃবিয়োগ হয়েছিল জন্মের বছরদুয়েকের মধ্যেই। সন্তানহীনা সূর্যবতী মাতৃস্নেহে লালন করেছিলেন শিশু অমরেন্দ্রকে।
কুমার প্রতাপেন্দ্র আর রানি সূর্যবতীর মধ্যে সমান ভাগাভাগি হয়েছিল জমিদারির বিষয়সম্পত্তি। জমিদারির বার্ষিক আয় ছিল লাখখানেকের ঢের বেশি। সে-যুগের নিরিখে কুবেরের বিষয়-আশয় প্রায়।
প্রতাপেন্দ্র মারা গেলেন ১৯২৯-এ। অমরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মধ্যে সম্পত্তির সমবণ্টন করে গিয়েছিলেন উইলে। অমরেন্দ্র তখনও নাবালক, বছর পনেরোর কিশোর। স্কুলের পাঠ শেষ করবেন কিছুদিনের মধ্যে। বিনয়েন্দ্রর বয়স তখন বাইশ, দায়িত্ব ছিল সম্পত্তির দেখাশোনার।
বিনয়েন্দ্র ছিলেন ইন্দ্রিয়সুখে আচ্ছন্ন মানুষ। জীবনদর্শন সহজ, “মেজাজটাই তো আসল রাজা, আমি রাজা নয়।” নানাবিধ দুর্লক্ষণ ছিল মেজাজের। দিনরাতের অধিকাংশ সময় ‘জলপথেই’ থাকতে পছন্দ করতেন। উদ্দাম নারীসঙ্গ স্বভাবগত, নিয়মিত নিশিযাপন বালিকাবালা এবং চঞ্চলা নামে দুই রক্ষিতার সাহচর্যে। প্রমোদবিলাসে মাঝেমধ্যে পাড়ি দিতেন বোম্বাই। রুপোলি পরদার রংবাহারে বরাবরের আকর্ষণ। সংযম এবং শৃঙ্খলা, দুইয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন কৈশোরেই।
অমরেন্দ্র ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। ভদ্র, নম্র, পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, নিয়মিত শরীরচর্চাও করেন। স্বভাবগুণে প্রবল জনপ্রিয় প্রজাকুলে। ‘ছোটবাবু’ বলতে অজ্ঞান পাকুড়ের আবালবৃদ্ধবনিতা।
স্কুলের পাট চুকিয়ে অমরেন্দ্র ভরতি হলেন পাটনা কলেজে। পড়াশুনোর খরচ নিয়মিত পাঠাতেও প্রায়ই গড়িমসি করতেন বিনয়েন্দ্র। অমরেন্দ্র আঠারোর চৌকাঠে পা দিলেন ফোর্থ ইয়ারে এবং সাবালকত্ব প্রাপ্তির পরই সম্পত্তির অংশের দায়িত্ব বুঝে নিতে চিঠি লিখলেন বিনয়েন্দ্রকে।
সেটা ১৯৩২ সাল। রানি সূর্যবতী থাকতেন দেওঘরে, সব খবরই পেতেন বিনয়েন্দ্রর টালমাটাল জীবনধারার। তিনিও পরামর্শ দিলেন অমরেন্দ্রকে, যথাসম্ভব দ্রুত বিষয়সম্পত্তি বুঝে নেওয়ার।
মাত্রাছাড়া ভোগবিলাসে অবধারিত টান পড়বে, তাই বৈমাত্রেয় ভাইকে তার প্রাপ্য অংশ দিয়ে দেওয়ায় বিনয়েন্দ্রর অনীহা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আইন তো আর অনীহার অনুগত নয়, অমরেন্দ্রকে বুঝিয়ে দিতে হল প্রাপ্য অর্ধাংশ। এবং হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা উৎপন্ন হল। বিস্তর চিঠিচাপাটি, তপ্ত বাক্যবিনিময়, সব।
পুজোর ছুটিতে অমরেন্দ্র বেড়াতে গেলেন দেওঘরে, রানি সূর্যবতীর কাছে। বিনয়েন্দ্রও এলেন কিছুদিন পরে। উঠলেন দেওঘরেরই অন্যত্র, বাড়ি ভাড়া করে। এক সন্ধেয় বিনয়েন্দ্র বললেন, চল বাবু (অমরেন্দ্রর ডাক নাম), একটু বেড়িয়ে আসি। বেরনো হল সান্ধ্যভ্রমণে। হঠাৎই বিনয়েন্দ্র বললেন, ‘তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি কলকাতা থেকে। এই দ্যাখ।’ বলেই পকেট থেকে বার করলেন শৌখিন নাকে-আঁটা চশমা (Pince-nez glasses)। একরকম জোর করেই পরিয়ে দিলেন ভাইকে। পরানোর সময় নাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ব্যথা পেলেন অমরেন্দ্র। ছড়েও গেল একটু।