শিকারের সন্ধানে পরের সপ্তাহদুয়েক এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, পার্ক স্ট্রিট, বালিগঞ্জ, আলিপুরে দিনভর ঘুরে বেড়াতেন দেবাশিস। বড়লোকরা তো এসব জায়গাতেই থাকে অধিকাংশ। কিন্ত ওভাবে কি হয়? অনেক ঘুরেফিরেও সুবিধে হচ্ছিল না। টার্গেট চিহ্নিত করছেন হয়তো, কিন্তু আলাপ জমাতে পারছেন না। প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখে যখন, এক সন্ধ্যায় আচমকাই সন্ধান পেলেন সম্ভাব্য শিকারের।
২ অক্টোবর। বিকেল-সন্ধের মাঝামাঝি তখন। এসপ্ল্যানেড থেকে যতীন দাস পার্কের টিকিট কেটে দেবাশিস প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছেন। দেখলেন, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে | দু’জনেরই বয়স তেরো-চোদ্দো হবে। ধোপদুরস্ত জামাকাপড়। দেবাশিস কান পাতলেন। দু’জনেই সিনেমা আর সিরিয়ালের গল্পে মগ্ন। ট্রেন এল। দুই কিশোরের পিছুপিছুই ট্রেনে উঠলেন। বসলেন ওদের পাশেই। গল্প তখনও লাগাতার চলছে সিনেমার।
“পরবর্তী স্টেশন পার্ক স্ট্রিট, আগলা স্টেশন পার্ক স্ট্রিট, দ্য নেক্সট স্টেশন ইজ় পার্ক স্ট্রিট।” ঘোষণা হতেই উঠে দাঁড়াল দু’জন। উঠে পড়লেন দেবাশিসও, ওদের সঙ্গেই নামলেন পার্ক স্ট্রিটে। প্ল্যাটফর্মেই আলাপ জমালেন দেবাশিস।
—এক্সকিউজ় মি, তোমাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?
—বলুন।
—আমি এইচ কে গুপ্ত। টিভি সিরিয়াল বানাই। একটু কথা বলতাম। তার আগে তোমাদের নামটা জানা দরকার।
—আমি অনুরাগ, অনুরাগ আগরওয়াল। আর ও সমীর প্যাটেল। সিরিয়ালের ব্যাপারে কী বলছিলেন…
—আসলে আমি একটা সিরিয়াল বানাচ্ছি। ‘সফেদ ধাগে’। একজন টিন-এজারের গল্প। অ্যাক্টর খুঁজছি, পাচ্ছি না। তোমাকে দেখে মনে হল, রোলটায় ভাল মানাবে। অবশ্য তুমি যদি রাজি থাকো, তবেই…
—কী বলছেন? আমরা রাজি, আর কে কে আছে সিরিয়ালে?
দেবাশিস বুঝতে পারেন, শিকার টোপ গিলেছে, এখন শুধু প্ল্যানমাফিক বঁড়শিতে গাঁথার অপেক্ষা।
—সব বলব, কিন্তু দু’জনকে তো নিতে পারব না। অনুরাগ এই ছবিটার জন্য পারফেক্ট। সমীর, তোমারটা পরের ছবিতে ভাবব। কিন্তু তোমার বাড়ির লোকজন রাজি হবেন তো অনুরাগ?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, হবে। শুরুতে বলব না, সিরিয়াল টেলিকাস্টের আগে সারপ্রাইজ় দেব।
—আসলে শুটিংয়ে কী হয় জানো, টাইমের ঠিক থাকে না কোনও। যখন-তখন ‘কল টাইম’ থাকে। তোমার বাড়িতে অ্যালাও করবে কি?
—ও আমি ম্যানেজ করে নেব আঙ্কল। সিরিয়াল কবে থেকে দেখাবে টিভিতে?
দেবাশিস হাসেন, পিঠে হাত রাখেন অনুরাগের।
—হবে হবে। তোমার পুজোর ছুটির মধ্যেই শুটিং সেরে ফেলব। এখন বাড়ির কাউকে কিছু না বলাই ভাল।
—বলব না আঙ্কল, নিশ্চিন্তে থাকুন।
অনুরাগের বাড়ি কোথায়, কে কে আছেন, কে কী করেন, টেলিফোন নম্বর কী, সব কথার মাঝে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন দেবাশিস। বললেন, ফোনে যোগাযোগ করবেন। সঙ্গে যোগ করলেন, বাড়ির অন্য কেউ ফোন ধরলে কিন্তু কেটে দেবেন। অনুরাগের গলা পেলে তবেই কথা বলবেন। না হলে বাড়ির লোক জেনে যাবে, আর জেনে গেলে অভিনয়ের অনুমতি না-ও দিতে পারেন। সকাল দশটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে করবেন আঙ্কল, আমিই ধরব, আশ্বস্ত করল অনুরাগ|
সন্ধেবেলা বিজনের বাড়িতে বসে প্ল্যান হল, কাজটা পরের দিনই সেরে ফেলতে হবে। ৩ অক্টোবর বেলা এগারোটা নাগাদ রাসেল স্ট্রিটের পোস্ট অফিস থেকে ফোন গেল অনুরাগের বাড়ি। দুটো নাগাদ ময়দান স্টেশনে আসতে বলা হল অনুরাগকে, তড়িঘড়ি চলেও এল অভিনয়ের স্বপ্নে বিভোর কিশোর।
দেবাশিস বললেন, ‘তোমার ‘লুক টেস্ট’ হবে আজ, ক্যামেরাম্যানের বাড়ি যাই চল।’ নিয়ে গেলেন বিজনের বাড়ি, এদিক–ওদিক চক্কর কেটে ঘুরপথে, যাতে চট করে আবার কখনও চিনে আসতে না পারে। বিজনের পরিচয় দিলেন ক্যামেরাম্যান হিসাবে, নাম মিস্টার রায়।
‘সফেদ ধাগে’ সিরিয়ালের বানানো গল্প শোনানো হল অনুরাগকে। বিজন ক্যামেরা নিয়ে নানা পোজ়ে ছবি তুললেন কিশোরের। আসল ‘কাজ’টা কিন্তু দেবাশিস-বিজন করে উঠতে পারলেন না সেদিন। সাহসে কুলোল না। পৌনে পাঁচটা নাগাদ অনুরাগ বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা-বাবা চিন্তা করবে এবার। দেবাশিস কালীঘাট স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ময়দান স্টেশনের টিকিট কেটে দিলেন।
পরের সাক্ষাতের দিন ঠিক হল ফোনমারফত। ৪ অক্টোবর, কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে। দুপুর একটায়। ফের বিজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল অনুরাগকে। ঘটনাচক্রে সেদিন কোনও প্রতিবেশীর বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠান, দিনভর আনাগোনা লোকজনের, হইচই | সেদিনও হল না, ফিরে গেল অনুরাগ, কিছু কাল্পনিক দৃশ্য অভিনয় করে দেখানোর পর।
সে-রাতে বিজন বললেন দেবাশিসকে, এভাবে ছেলেটাকে বারবার বাড়িতে আনা ঝুঁকির হয়ে যাচ্ছে। পাড়ার কিছু লোকজনের চোখে তো পড়ছেই। যা করার, খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর দেরি করাটা মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে যাবে।
ঠিক হল, ৬ তারিখ দুপুরে ফের ডাকা হবে অনুরাগকে। আর সেদিনই এসপার-ওসপার।
৬ অক্টোবর, দুপুর দেড়টা। কথা হয়েছিল ফোনে আগেই। অনুরাগকে নিয়ে দেবাশিস কসবায় পৌঁছতেই বিজন বললেন, ‘শুটিং শুরু পরের সপ্তাহে, আজকে তো ফাইনাল ‘লুক টেস্ট’। কিন্তু তোমার মুখটা তো একদম রোদে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। এতে তো চলবে না ভাই।’
অনুরাগ শুনেই ভীষণ মুষড়ে পড়ল। সাজানো চিত্রনাট্যে দেবাশিস-বিজনের পরের সংলাপ হল এরকম।