অনুরাগ আগরওয়াল অপহরণ ও হত্যা মামলা। পার্ক স্ট্রিট থানা, কেস নম্বর ৬৩১, তারিখ ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৮। ১২০ বি/৩৬৮/৩৮৪/৩০২/২০১ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, খুন এবং প্রমাণ লোপাট। এই মামলা, বহুব্যবহারে মরচে পড়ে যাওয়া তুলনাতেই বলি, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের টুপিতে উজ্জ্বল পালক। যে মামলা প্রসঙ্গে মাননীয় কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিলেন, “The prosecution case as aptly observed by the learned Trial Judge reminds us of a story taken from a thriller.”
অনুরাগ আগরওয়াল
ঘটনা আটের দশকের শেষাশেষির। যাঁরা এখন চল্লিশের কোঠায়, তাঁরা নিশ্চয় ফিরে দেখতে পাবেন সময়টা, অনায়াসে। আজকের মতো হাজার খানেক টিভি চ্যানেল ছিল না তখন। ছিল না ২৪ x ৭ শুধু সিরিয়াল-সিনেমার জন্যই নির্দিষ্ট গোটা পঞ্চাশ বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি চ্যানেল। খেলা বা খবরের জন্যও বরাদ্দ থাকত হাতে গোনা গুটিকয়েক। সপ্তাহে একদিন হাপিত্যেশ করে বসে থাকা ‘চিত্রহার’-এর অপেক্ষায়। হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠান। শেষ হয়ে গেলে আক্ষেপ, মাত্র চার-পাঁচটা গান দেয়, এত বিজ্ঞাপনের কী দরকার? স্কুল-কলেজ-পাড়ায় আলোচনা অবধারিত পরের দিন, এ বারেরটা জমল না তেমন, বা শেষ গানটায় পয়সা উসুল!
তখন সিরিয়াল বলতে ’৮৪-র ‘হামলোগ’, ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে প্রথম সোপ অপেরা। যা আবির্ভাবেই তুমুল জনপ্রিয়। প্রতি এপিসোডের শেষে অশোককুমারের কয়েক মিনিটের ভাষ্য আর অননুকরণীয় ‘হামলোগ’ দিয়ে শেষ করা। বছর দুয়েক পরে বোকাবাক্সের পরদা দখল করবে ‘বুনিয়াদ’, দেশ ভাগের পটভূমিতে তৈরি সিরিয়াল | অলোকনাথ আর অনিতা কানওয়ারের হাত ধরে ‘মাস্টারজি’ আর ‘লাজোজি’ ঢুকে পড়বেন আম ভারতীয় পরিবারের হেঁসেলে। সোপ অপেরার সৌজন্যে হাট করে খুলে যাবে বহুদিনের বন্ধ থাকা একটা দরজা। যার জেরে পরের কয়েক দশকে ভারতীয় টেলিভিশনে আছড়ে পড়বে সিরিয়াল-সুনামি।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, উপরের দুটো অনুচ্ছেদ বাড়তি মনে হতে পারে। কিন্তু প্রেক্ষিতের স্বার্থে প্রয়োজন ছিল। অনুরাগের কথায় ফিরি। জন্ম ’৭৪-এ। বেঁচে থাকলে বয়স হত মাঝচল্লিশ। সিরিয়াল-সিনেমার আকর্ষণ কৈশোরে অনেকেরই থাকে। অনুরাগেরও ছিল, কিন্তু অস্বাভাবিক বেশি মাত্রায়। টিভির পোকা বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। সিরিয়াল-সিনেমা দেখা অনুরাগের কাছে ছিল সাধনার মতো। ডায়লগ মুখস্থ করত, ঘরে অভিনয় করত আয়নার সামনে, পড়াশোনা–খেলাধুলোর মতো নেহাতই ‘তুচ্ছ’ জাগতিক বিষয়ে মাথা ঘামাতে তীব্র অনীহা ছিল বছর চোদ্দোর কিশোরের। আশা-আকাঙ্ক্ষা-সাধ-আহ্লাদ বলতে একটাই, রুপোলি পরদায় মুখ দেখানো। সেটাই কাল হবে, কে ভেবেছিল?
কারা করেছিল অপহরণ? কীভাবে? কাহিনি পিছিয়ে যাক কয়েক মাস আগে, কিডন্যাপ-কাণ্ডের পান্ডাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
দেবাশিস ব্যানার্জি, বয়স তখন তিরিশ ছাড়িয়েছে| বাড়ি তিলজলার সি এন রায় রোডে। জীবিকা বলতে ছোটখাটো অর্ডার সাপ্লাই। বাবা মারা গিয়েছেন, মা কিছু টাকা পেনশন পান ‘পলিটিক্যাল সাফারার’ হিসেবে। মধ্যবিত্ত পরিবার, সচ্ছল নয় একেবারেই। যাদবপুরে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন দেবাশিস। সেখানেই ’৮৬ -তে আলাপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কাবেরীর সঙ্গে। আলাপ গড়াল প্রেমে, ’৮৮–র জানুয়ারিতে দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল বিয়ের।
বিয়ের খরচাপাতির ব্যবস্থা করতে গিয়ে টাকাপয়সার সমস্যা দেখা দিল। কিন্তু সব পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে, দিন আর পিছনো যায় না। বিয়েতে ধারদেনা হল কিছু। যা ক্রমে বাড়তে থাকল বিয়ের পর, লোকলৌকিকতা ইত্যাদিতে। ব্যবসাতেও মন্দা চলছে তখন। সংসার চালাতে দেবাশিসের নাভিশ্বাস উঠল মাসছয়েকের মধ্যেই। মেজোশ্যালক রেলে কনট্র্যাক্টর ছিলেন, চেষ্টা করলেন দেবাশিসকে কিছু অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার। সুবিধে হল না তেমন। শ্যালকের থেকে দেবাশিস ধারও নিলেন হাজার বিশেক, শোধ করতে পারলেন না। কাবেরী প্রায়ই দুঃখ করতেন, দাদার টাকাটা ফেরত দিয়ে দাও, বাপের বাড়িতে লজ্জায় মাথা কাটা যায় আমার।
কসবার মসজিদবাড়ি লেনে থাকতেন দেবাশিসের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিজন বড়ুয়া, বিজ্ঞানের স্নাতক। প্রাইভেট টিউশন এবং একটি ওষুধের দোকানে টুকটাক কাজ করেই যাঁর দিনগুজরান। অবিবাহিত, একাই থাকেন। আর্থিক অবস্থা করুণ বিজনেরও। ধারদেনা তাঁরও বিস্তর।
দুই বন্ধু সান্ধ্য আড্ডায় প্রায়ই ভাবতেন, এভাবে তো আর চলে না, দেনার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে কতদিন আর টানা যাবে এভাবে? টাকার দরকার, কিন্তু কে দেবে? রাতারাতি লটারি লেগে যাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই পোষাবে না। তা হলে? কথায় কথায় একদিন মাথায় এল, কিডন্যাপিং করলে কেমন হয়? চটজলদি বড়লোক হওয়ার আর তো কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না।
ছক কষা শুরু করলেন দুই বন্ধু। কয়েকটা ব্যাপার ঠিক করে নিলেন প্রথমেই। এক, বিশাল ধনী কোনও পরিবারের ছেলেকে টার্গেট করা ঝুঁকির হয়ে যাবে। কাগজে বেরবে, জানাজানি হবে, পুলিশ ঝাঁপাবে। তার চেয়ে ভাল, মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের কাউকে কিডন্যাপ করা। টাটা–বিড়লা জাতীয় নয়, কিন্তু মুক্তিপণ দেওয়ার মতো টাকা আছে, এমন। দুই, যা করতে হবে, ভুলিয়েভালিয়ে। জোরজার করে নয়। তিন, অপহৃতকে রাখার জায়গা চাই। দেবাশিস বললেন বিজনের বাড়িতে রাখার কথা। বিজন শুরুতে গররাজি হলেও মেনে নিলেন শেষ পর্যন্ত| চার, কিছু সরঞ্জাম চাই। মুখ বাঁধার জন্য লিউকোপ্লাস্ট কিনলেন দেবাশিস, বাগরি মার্কেট থেকে air purifier mask। ভাবনা, কিডন্যাপ করার পর এই ঢাকনা মুখে পরিয়ে দিয়ে উপরে ফোঁটা ফোঁটা ক্লোরোফর্ম ঢালবেন, যা অপহৃতের নাকে ঢুকবে। তাতে ব্যাপারটা নিরাপদ থাকবে। কতটা দিতে হবে জানা নেই, ডোজ় বেশি হয়ে গেলে যদি ঘুমই না ভাঙে? বিজন জোগাড় করলেন pethidine ইঞ্জেকশন আর ক্লোরোফর্ম। পাঁচ, সম্ভাব্য শিকার খুঁজবে কে? টিউশনির ফাঁকে সময় বের করা মুশকিল বিজনের, খোঁজার ভার নিলেন দেবাশিস।