—কী ঠিক করলেন? বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।
—আপাতত আশি হাজার দিচ্ছি। বাকিটা দু’-একদিনের মধ্যে দিয়ে দেব।
—হুঁ, টাকা রেডি রাখুন, কখন কীভাবে কোথায় দেবেন, সন্ধেবেলা জানিয়ে দেব।
—কিন্তু মালতুর সঙ্গে একবার…
—বলছি তো, টাকা পেলে পরশু দিন বিকেলে বাড়ি পৌঁছে যাবে।
কেউ কেউ বললেন, পুলিশে জানিয়ে রাখা যাক। রাতভর আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, টাকা দেওয়া হোক। মালতু আগে বাড়ি ফিরুক, তারপর পুলিশে জানানোর কথা ভাবা হবে। ঘরের ছেলের প্রাণ আগে, না অপরাধীর ধরা পড়া আগে? না কি টাকা আগে? আগে মালতু ফিরুক।
অপহরণের মামলায় এই এক মুশকিল। একবার নয়, বারবার দেখেছি আমরা। জানাজানি হয়ে গেলে, মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে গেলে অন্য কথা। কিন্তু যদি সেটা না হয়, জানতে না পারে কেউ পরিবার-পরিজন ছাড়া? মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এলে, পুলিশকে জানালে অপহৃতকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখালে, স্বাভাবিক দোলাচলে ভুগতে থাকে পরিবার। পুলিশকে জানাব কি জানাব না?
সত্যি বলতে, দোষও দেওয়া যায় না ভুক্তভোগী পরিবারকে| এ তো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-শ্লীলতাহানি নয় যে অভিযোগ করে দিলাম, এবার পুলিশ যা করার করুক। প্রিয়জন জীবিত অবস্থায় অন্যের হেফাজতে বন্দি| এবং যে বা যাদের হাতে বন্দি, জানা নেই তারা কতটা বিপজ্জনক, কতটা মরিয়া। এমন অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক স্তরে পুলিশে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতেই পছন্দ করে অপহৃতের পরিবার, অভিজ্ঞতা আমাদের। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে প্রিয়জন বাড়ি ফেরার পরই পুলিশকে জানান, কেউ কেউ আদৌ জানানই না।
এক্ষেত্রেও ভয় পেয়েছিলেন আগরওয়াল পরিবার। পুলিশে জানালে পাছে ক্ষতি হয়ে যায় অনুরাগের, সেই আশঙ্কায় মুক্তিপণের টাকা দিয়েছিলেন। যখন জানালেন, তখন চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, যা পূরণ হওয়ার নয়।
পুলিশের দিকটাও বলা দরকার। অভিযোগ যদি সাহস করে কেউ করেও ফেলেন অপহরণের, সাবধানে, খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় পুলিশকে। মাথায় রাখতে হয়, অপরাধী তো ধরতে হবেই, কিন্তু নিরপরাধ প্রাণের মূল্যে নয়। অপহৃত ফিরে আসুক নিরাপদে, তারপর ঝাঁপানো যাবে, এই ভাবনা কাজ করেই। রক্ষণ মজবুত করে তবেই আক্রমণে যাওয়া। গ্রেফতার, মুক্তিপণের টাকা উদ্ধার, এসব পরেও হতে পারে, বিলক্ষণ সম্ভব। কিন্তু অপহৃতের প্রাণহানির ন্যূনতম ঝুঁকি থাকতে পারে, এমন কিছু করার আগে হাজারবার ভাবি আমরা|
ঠিক হল,বাড়ির বিশ্বস্ত ড্রাইভার ভবন শর্মাকে নিয়ে দেবীলালের দীর্ঘদিনের সহকর্মী দীনদয়াল উপাধ্যায় টাকা নিয়ে যাবেন। ফোন এল সাড়ে ছ’টায়| যা কথোপকথন হল, কাহিনির শুরুতে পড়েছেন। হাজরা মোড়ে রওনা হলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। যেমনটা নির্দেশ এসেছিল, অক্ষরে অক্ষরে মেনে। কতটুকুই বা দূরত্ব মিডলটন স্ট্রিট থেকে হাজরার? দীনদয়াল যখন পৌঁছলেন বসুশ্রীর সামনে, ঘড়িতে সাতটা দশ। মানে এখনও হাতে মিনিট দশেক। নেমে দাঁড়ালেন, হাতে প্যাকেট। ব্রাউন পেপারের, লাল রিবন দিয়ে বাঁধা। ভিতরে আশি হাজার নগদ| গাড়িতে গিয়ে বসলেন কয়েক মিনিট পর। ঘড়ির কাঁটা সোয়া সাতটা ছুঁয়ে ফেলেছে তখন।
দোকানবাজারের হইহল্লা, গাড়িঘোড়ার ভিড়ভাট্টা, অফিসফিরতি জনতা পিলপিল। ভরসন্ধের হাজরা মোড় গমগম করছে তখন, যেমন করে আজ-কাল-পরশু। কাঁটায় কাঁটায় সাতটা কুড়িতে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বছর দশেকের একটি ছেলে। খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন দীনদয়াল। নাহ্, চেহারায় বিশেষত্ব বলতে কিছু নেই। নোংরা শার্ট, ঢিলেঢালা হাফপ্যান্ট, পায়ে চটিও নেই। নেহাতই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বুঝতে বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন নেই।
হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা রিস্টওয়াচ বার করল ছেলেটি। দীনদয়াল হাতে নিয়ে দেখালেন ড্রাইভার ভবনকে| দেখেই ঘাড় নাড়ল ভবন, মালতু ভাইয়া কি হি হ্যায়। শুনে আর একটা কথাও খরচ করলেন না দীনদয়াল। হাতবদল হয়ে গেল ব্রাউন পেপারের প্যাকেট। যেটা নিয়েই দৌড় দিল ছেলেটি, মিশে গেল থিকথিকে ভিড়ে।
পৌনে আটটা নাগাদ মিডলটন স্ট্রিটে ফিরলেন দীনদয়াল। রিস্টওয়াচ দেখে আর এক প্রস্থ কান্নাকাটি শুরু হল। Citizen Quartz white dial, এ ঘড়ি মালতুরই। নিউ মার্কেট থেকে নাতিকে কিনে দিয়েছিলেন দাদুই| মা-দিদি-ঠাকুমার অঝোর কান্না থামালেন শৈলেন্দ্র, টাকা দেওয়া হয়েছে। মালতু কালই ফিরে আসবে। জানতেন না, ওই আশ্বাসবাণী কত ঠুনকো শোনাবে মাত্র এক ঘণ্টা পরে!
আগরওয়ালদের বাড়িতে ফোন বাজল রাত ন’টায়। তুললেন দেবীলাল, অন্যপ্রান্তে পরিচিত গলা। মিস্টার গুপ্ত।
—কী হল মিস্টার আগরওয়াল! টাকা তো পেলাম না।
—মানে? পেলেন না মানে? উপাধ্যায় প্যাকেট দিয়েছে একটা বাচ্চা ছেলের হাতে। ছেলেটা মালতুর ঘড়িও দিয়েছে।
—ছেলেটাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না | চালাকি করবেন না আমাদের সঙ্গে।
—কী বলছেন আপনি? দিস ইজ় অ্যাবসোলুটলি ফলস। আপনি কথা দিয়েছিলেন, মালতুকে ছেড়ে দেবেন টাকা পেলে।
—টাকা পেলে দেব বলেছিলাম। টাকাই তো পাইনি!
ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ পান দেবীলাল, বসে পড়েন মাথায় হাত দিয়ে|
এবার? কী করণীয়? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল পরিবার। পুলিশকে জানাতেই হবে, রাস্তা নেই এ ছাড়া| মামলা দায়ের হল পার্ক স্ট্রিট থানায়। তদন্তের দায়িত্ব পড়ল গোয়েন্দা দফতরের তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর দুলাল চক্রবর্তীর উপর। যিনি সফল কর্মজীবনের শেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন।