—কিন্তু আমার নাতি…মালতু..
—টাকা পাই, নাতি কাল আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। পুরো আশিই আনছেন তো?
—হ্যাঁ, কিন্তু… একবার যদি ওর সঙ্গে কথা বলা যায়…
—ওকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ঘুমোচ্ছে।
—কিন্তু…
—কোনও কিন্তু নেই। আপনার সন্দেহ হচ্ছে তো, নাতি সত্যিই আমাদের কাছে কি না। টাকা নেওয়ার সময় আমার লোক আপনার নাতির রিস্টওয়াচটা দিয়ে দেবে আপনার লোকের হাতে।
—আচ্ছা আচ্ছা…
—তা হলে ওই কথাই রইল। পুলিশকে জানালে কিন্তু জেনে যাব, মনে থাকে যেন। সাতটা কুড়ি, বসুশ্রী। ঠিক আছে?
গুলমোহন ম্যানসন, ৬০ মিডলটন স্ট্রিট। ফ্ল্যাট নম্বর ৪৩, পাঁচতলায়। এখানেই দীর্ঘদিনের বাস আগরওয়াল পরিবারের। তেষট্টি বছর বয়সি দেবীলাল পরিবারের মাথা, French Motors-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কর্মরত। আগরওয়ালদের আদি বাড়ি উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে। দুই ছেলে দেবীলালের। শৈলেন্দ্র আর মুরারিলাল। যাঁরা গোরখপুরেই থাকেন, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির পারিবারিক ব্যাবসা দেখাশোনা করেন।
শৈলেন্দ্রর দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েরা থাকে গোরখপুরেই, বাবা-মায়ের সঙ্গে। ছেলে অনুরাগ সবচেয়ে ছোট, ডাকনাম মালতু | কলকাতায় দাদু-ঠাকুমার কাছে থেকে পড়াশোনা করে। বয়স চোদ্দো, এলগিন রোডের জুলিয়ান ডে স্কুলে ক্লাস সিক্স, সেকশন ই। দেবীলালের ছেলেরা সপরিবারে মাঝে মাঝে আসেন কলকাতায়, সময় কাটিয়ে যান মা-বাবার সঙ্গে।
দাদু-ঠাকুমার নয়নের মণি অনুরাগ, বিশেষ করে দাদুর। চোখে হারান নাতিকে। মালতুও অসম্ভব ন্যাওটা দাদুর। যত রাগ-অভিমান-বায়না-আবদার ওই দাদুর কাছেই। বাবা-মা অনেকবার চেয়েছেন গোরখপুরে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে, ওখানের স্কুলে ভরতি করে দিতে। অনুরাগ রাজি হয়নি | দেবীলাল মুখে কিছু বলেননি, কিন্তু নাতির ইচ্ছায় মনে মনে আহ্লাদিত হয়েছেন খুব।
সালটা ১৯৮৮। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তীর্থযাত্রায় বেরলেন দেবীলাল। স্ত্রী অসুস্থ, একাই গেলেন। গোরখপুর থেকে সস্ত্রীক শৈলেন্দ্র চলে এলেন কলকাতায়, বড়মেয়ে সংগীতাকে সঙ্গে নিয়ে। বাবা যে ক’দিন বাইরে, মায়ের দেখাশোনার প্রয়োজন। তার উপর অনুরাগ রয়েছে।
অনুরাগের তখন পুজোর ছুটি চলছে। দুপুর-বিকেলে কাছেপিঠে প্রায় রোজই বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-সেদিক ঘুরতে যেত। কখনও চিড়িয়াখানা, কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও জাদুঘর। ফিরে আসত সন্ধে নামার আগেই।
১২ অক্টোবর দুপুরে দিদি সংগীতা হঠাৎ খেয়াল করলেন, ভাই নিজের ঘরে নেই। কোথায় গেল? মা-কে জানালেন| খোঁজ খোঁজ। বহুতলের দারোয়ানের থেকে জানা গেল, অনুরাগকে দেখেছেন দুপুর একটা নাগাদ কাঁধে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বেরতে| মা আর দিদি ভাবলেন, বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করতে গিয়েছে কোথাও। না জানিয়ে বেরনোর জন্য বাড়ি ফিরলে বকাবকি করবেন, ভেবে রাখলেন দু’জনেই।
কিন্তু ফিরলে তো? বিকেল পেরিয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত। ফিরল না অনুরাগ। স্কুলের বন্ধুদের বাড়িতে ফোন করা হল, শৈলেন্দ্র প্রতিবেশীদের নিয়ে চষে ফেললেন পার্ক স্ট্রিট-ভিক্টোরিয়া-চিড়িয়াখানা চত্বর-প্রিন্সেপ ঘাট-ইডেন গার্ডেন। নেই, কোত্থাও নেই। বিনিদ্র রাত কাটল আগরওয়াল পরিবারের।
পরের দিন সকালে দেবীলাল ফোন করলেন কলকাতার বাড়িতে, বাইরে গেলে রোজ যেমন করে থাকেন। শুনলেন দুঃসংবাদ, ছেলেকে বললেন অবিলম্বে পুলিশে মিসিং ডায়েরি করতে। এবং পত্রপাঠ রওনা দিলেন কলকাতায়। পার্ক স্ট্রিট থানায় ১৩ অক্টোবর জমা পড়ল অনুরাগের ছবি, ডায়েরির পর প্রাথমিক খোঁজখবর শুরু করল পুলিশ। আজ থানায় ছবি পাঠানো, কোথাও কোনও দুর্ঘটনা হয়েছে কি না ইত্যাদি।
১৪ অক্টোবর, সকাল ১০টা। দেবীলাল ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন গোরখপুরে। কলকাতার ট্রেন ধরবেন | হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে ঢুকতে রাত সাড়ে এগারোটা হবে। গোরখপুর স্টেশন থেকেই ফোন করলেন বাড়িতে। এবং খবর শুনে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। গলা কাঁপছে শৈলেন্দ্রর, জানালেন, এক ঘণ্টা আগে ‘মিস্টার গুপ্ত’ নামে একজন ফোন করে জানিয়েছেন, অনুরাগকে তাঁরা কিডন্যাপ করেছেন। মুক্তির বিনিময়ে দাবি এক লাখ টাকা। পুলিশকে কিছু জানালে মালতুকে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে হুমকিও দিয়েছেন |
ফের ফোন এলে একদিন সময় চেয়ে নিতে বললেন দেবীলাল| পরামর্শ দিলেন পুলিশকে এখনই কিছু না জানাতে| আরও বললেন, ব্যাংক থেকে তিরিশ হাজার টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুলে নিতে। বন্ধুবান্ধবদের থেকে বাকিটাও জোগাড় করে রাখতে।
১৪ তারিখই ফোন এল আরও কয়েকবার। হুমকি, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে টাকা না পেলে মেরে ফেলা হবে অনুরাগকে। সঙ্গে রুটিন সতর্কবার্তা, পুলিশকে জানালে পরিণতি মারাত্মক হবে। শৈলেন্দ্র বললেন, বাবা বাইরে আছেন। একটু সময় চাই।
দেবীলাল বাড়িতে ঢুকলেন মাঝরাতে। অফিসের সহকর্মী আর আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরতি। আশঙ্কা আর আতঙ্কে পুরো পরিবার প্রায় আচ্ছন্ন তখন। French Motors-এর সহকর্মীরা যে যত পেরেছেন, টাকা নিয়ে এসেছেন, শৈলেন্দ্র টাকা তুলেছেন ব্যাংক থেকে। দেখা গেল, আশি হাজার জোগাড় হয়ে গিয়েছে।
পরের দিনের সকাল, ১৫ অক্টোবর। ঠিক ন’টায় ফোন বাজল। অন্যদিকে মিস্টার গুপ্ত |