কিছু মামলা আসে কদাচিৎ, যখন স্রেফ রোজকার পেশাগত দায়বদ্ধতার সীমানার বাইরেও তৈরি হয় দোষীকে শাস্তিদানের বাড়তি মানবিক তাগিদ। দেবযানী মামলাও ছিল এমনই ব্যতিক্রমী। মিডিয়ার ঢক্কানিনাদের জন্য শুধু নয়। ঊর্ধ্বতনের চাপে শুধু নয়। এক নির্দোষ গৃহবধূর নির্মম হত্যাকাণ্ডে যাতে সাজা হয় দোষীদের, নিশ্চিত করতে পেশাগত প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে দলগতভাবে ঝাঁপিয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর। তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যালের সুযোগ্য নেতৃত্বে। কোনও কোনও বিরল মামলায় অভিযুক্তের অপরাধ সম্পর্কে যখন নিশ্চিত হই আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ-তথ্যতালাশের পর, তখন মনে হয় আমাদের, যা হওয়ার হোক। শেষ পর্যন্ত যাব। শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলে। চলতেই থাকে।
দুরন্ত লড়েছিলেন তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যাল। সুজিতের বৈশিষ্ট্য ছিল, এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতেন ঘটনার সঙ্গে, নাওয়াখাওয়াও ত্যাগ করতেন কখনও কখনও। তদন্ত শুধু পেশা ছিল না, নেশাও। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে তাঁর অধীনে যাঁরা কাজ করেছেন কোনও না কোনও সময়, তাঁরা আজও শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান সুজিতবাবুর প্রসঙ্গ উঠলে। গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন পদে সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর অবসর নিয়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে।
বিচার শুরু হল। বিত্রার বিচার শুধু জুভেনাইল কোর্টে, যেহেতু তখনও নাবালিকা। বণিক পরিবার জলের মতো টাকা খরচ করলেন উকিলদের পিছনে। দাবি করা হল, চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম ঘটনার সময় ছিলেনই না বাড়িতে। ধৃত মহিলারাও নির্দোষ, আর কীসের খুন? দেবযানী তো আত্মহত্যা করেছেন। দীর্ঘ সওয়াল-জবাবে ধোপে টেকার কথা ছিল না এই মিথ্যাচারের। টেকেওনি। যদু-শান্তির সাক্ষ্য তো ছিলই। যে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল দেবযানীর মাথায়, তাতে হাতের ছাপ ছিল চন্দনের। যে হোটেল দুটিতে ঘটনার পর ঠাঁই নিয়েছিলেন চন্দ্রনাথরা, তার রেজিস্টারের লেখার সঙ্গে চন্দ্রনাথের হাতের লেখা মিলে গিয়েছিল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। সর্বোপরি দেবযানীর লেখা চিঠিগুলি তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করেছিল ধারাবাহিক নির্যাতন।
আদালতে চত্বরে চন্দ্রনাথ বণিক
আর আত্মহত্যার তত্ত্ব? খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ড. রবীন বসুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে। দেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল, প্রতিটির খুঁটিনাটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিল সেই রিপোর্ট। পরিষ্কার বলা হয়েছিল, মাথার আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল, চিড় ধরে গিয়েছিল দেবযানীর খুলিতে। এলোপাথাড়ি যত্রতত্র আঘাতের তীব্রতাতেই মৃত্যু, “fissured fracture on the vault of her scull and several other injuries, all ante-mortem and homicidal in nature.” আর গলায় ফাঁসের দাগ, পুলিশি পরিভাষায় ‘ligature mark’? রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা ছিল, “post-mortem hanging”। অর্থাৎ, মৃত্যুর পর দেহ ঝোলানো হয়েছিল।
’৮৫-র এপ্রিলে রায় দিলেন আলিপুর কোর্ট। জয়ন্তী, সুমিত্রা আর অসীমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ। জজসাহেব লিখলেন, “But the part played by accused Chandranath irrespective of his age and that of accused Chandan deserve the severest punishment enjoined by the law and no leniency need be shown to them having regard to the facts and circumstances of the case.”
হাইকোর্টে গেলেন বণিকরা। রায় আংশিক বদলাল। চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকল। সুমিত্রার যাবজ্জীবনেরও। অসীম আর জয়ন্তীর শাস্তি কমে দাঁড়াল দু’বছরের সশ্রম কারাবাসে।
বল যথারীতি গড়াল সুপ্রিম কোর্টে। যেখানে চন্দ্রনাথ-চন্দনের ফাঁসির আদেশ রদ করে রায় দেওয়া হল যাবজ্জীবন কারাবাসের। ১৪ বছর পর মুক্তি পেলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন-সুমিত্রা। চন্দ্রনাথ গত হয়েছেন। বাকিরা বর্তমান। জুভেনাইল কোর্টে বিচারপর্বে দোষী সাব্যস্ত বিত্রাও। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মামলা থেকে মুক্তি পান ঘটনার বছরতিনেক পর।
পড়লেন তো। কী-ই বা বলার আর? বাংলা শব্দকোষকে বড় নিঃস্ব দেখায় বিশেষণ খুঁজতে বসলে। করুণ? হৃদয়বিদারক? না কি মর্মান্তিক? বৃথা চেষ্টা, সব অনুভূতিকে কি আর শব্দের পোশাক পরানো যায়?
ঘটনা যতটা বেদনার, স্থাপনাও ততটাই বেদনাদায়ক ছিল, পরিশেষে স্বীকার করি নির্দ্বিধায়।
১.০৫ লাশই নেই, খুন কীসের?
[অনুরাগ আগরওয়াল হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার দুলাল চক্রবর্তী]
—আবার বলছি মিস্টার আগরওয়াল, পুলিশকে কিছু জানাবেন না। জানালে পস্তাতে হবে। নাতিকে আর দেখতে পাবেন না কখনও।
—জানাব না। ওকে কিছু করবেন না মিস্টার গুপ্ত, প্লিজ়! বলছি তো, টাকা দেব। যা বলবেন, করব।
—বসুশ্রী সিনেমা চেনেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, হাজরা মোড়…
—রাইট। সন্ধে ৭টা ২০ নাগাদ গাড়ি নিয়ে আসবেন। বসুশ্রীর কাছে দাঁড় করাবেন। টাকা ব্রাউন পেপারে মুড়ে একটা চওড়া লাল রিবন দিয়ে বাঁধবেন। দেখে যাতে চেনা যায়।
—আচ্ছা… আমার এক কলিগ যাবে…দীনদয়াল উপাধ্যায়।
—ওঁকে বলবেন, গাড়ি থেকে নেমে টাকার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মিনিটখানেক দাঁড়াতে। তারপর আবার গাড়িতে গিয়ে বসতে বলবেন। আমার লোক যাবে গাড়ির কাছে। তাঁকে প্যাকেটটা দিয়ে দিতে বলবেন।