কিল-চড়-লাথি-ঘুসি তো ছিলই যেমন খুশি, লাঠি দিয়েও সজোরে দেবযানীর মাথায় মেরেছিলেন চন্দন। সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন দেবযানী। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু তৎক্ষণাৎ। খুনকে আত্মহত্যার চেহারা দিতে এর পর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিলিং ফ্যানে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দেবযানীর ঘর। বাচ্চাদের বলা হয়েছিল, মায়ের শরীর খারাপ, ঘুমোচ্ছে। তোমরা অন্য ঘরে থাকো। কতই বা বড় ওরা তখন, বাবার কথা মেনে নিয়েছিল নিষ্পাপ বিশ্বাসে।
রাত গভীর হলে চন্দ্রনাথরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, আত্মহত্যার গল্পটা না-ও দাঁড়াতে পারে। আপাতত দেহ লুকিয়ে ফেলা যাক। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় ফোল্ডিং খাটের ভেতর দেবযানীর দেহ পুরে দেওয়া হল। কীভাবে, শুরুতে লিখেছি বিস্তারিত।
পরদিন সকাল। ২৯/১/৮৩। একটি সুটকেস নিয়ে দশটা নাগাদ চন্দ্রনাথ-চন্দন বেরলেন। গোলপার্কের ইন্ডিয়ান ওভারসিজ় ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা তুললেন। এবং সোজা পৌঁছলেন পারিবারিক চিকিৎসক অজিতকুমার ব্যানার্জির চেম্বারে। বললেন, ‘এক মহিলা গৃহকর্মী মারা গিয়েছেন। একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে।’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘মৃতদেহ না দেখে সেটা কী করে সম্ভব?’ চন্দ্রনাথ সুটকেস খুললেন, যাতে সদ্য ব্যাংক থেকে তোলা এক লাখ। বললেন, ‘কত লাগবে আপনার?’
টাকার গরমের এই এক মুশকিল, সব কিছুই ক্রয়যোগ্য ভাবায় কখনও কখনও। ডাক্তারবাবু শুনে হাসলেন। সুটকেস বন্ধ করে দিয়ে বললেন, যতই দিন, এ জিনিস আমার দ্বারা হবে না। আসুন আপনারা।
বেরনোর আগে শেষ প্রশ্ন করলেন চন্দ্রনাথ, ‘ময়নাতদন্তে কি বোঝা যায়, খুন, না আত্মহত্যা?’ ডাক্তার ব্যানার্জি বললেন, ‘সে তো যায়ই। খুব সহজ। কিন্তু এ প্রশ্ন করছেন হঠাৎ?’ চন্দ্রনাথ-চন্দন আর দাঁড়ালেন না, ফিরলেন বাড়ির পথে। কন্ট্রোল রুমে সে রাতের ফোনটা কি ডাক্তারবাবুই করেছিলেন? কে জানে!
এদিকে নিয়মমতো ২৯ তারিখ সকালে কাজে এলেন ঊর্মিলা আর যদু। শান্তিও এল, পুষ্পাও ফিরে এসেছে বাড়ি থেকে। ভয় দেখিয়ে কি আর মুখ বন্ধ করা যায় সব সময়? যদু আর শান্তি খুলে বলল ঊর্মিলাকে, আগের দিন বিকেলে যা যা ঘটেছিল, যা যা দেখেছিল, সব। ঊর্মিলা সাহস করে জানতে চাইলেন চন্দনের কাছে, বড়বউদিকে দেখছি না। কোথায়? উত্তর এল, বাপের বাড়ি গিয়েছে গত রাতে। ভাইরা এসে নিয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা দেখল, মায়ের ঘর এখনও বন্ধ। চন্দন বোঝালেন, মা বর্ধমান গিয়েছে, কয়েকদিন পরই ফিরবে।
রাত বাড়ল। প্রায় দশটা। ঊর্মিলা কাজ সেরে ফিরে গিয়েছেন। যদুও বেরনোর তোড়জোড় করছে। পুষ্পা আর শান্তি রয়েছে। বেল বাজল ফ্ল্যাটের, থানা থেকে আসছি, দরজা খুলুন প্লিজ়। আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। পাঁচতলা থেকে ছ’তলায় ওঠার দরজা দিয়ে উপরে উঠে গেলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম। সাফাইকর্মীদের ব্যবহারের জন্য ছিল ঘোরানো সিঁড়ি। নেমে গেলেন নীচে, পালালেন নিঃশব্দে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকের গেট দিয়ে। যদু-শান্তি-পুষ্পাকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিলেন সুমিত্রারা। শাসালেন, ‘কিচ্ছু বলবি না পুলিশকে। মারলেও মুখ খুলবি না কেউ।’
পুলিশ ঢুকল দরজা ভেঙে। যা হল এর পর, লিখেছি। কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সেখানে কে চন্দ্রনাথ, কে-ই বা চন্দন-অসীম? আর কে-ই বা সুমিত্রা-জয়ন্তী-বিত্রা?
চন্দ্রনাথরা পালালেন কোথায়? প্রথমে মহাত্মা গাঁধী রোডের ‘Hoteliers Associates’-এ আগরতলার রমেশ দত্ত পরিচয়ে ঘর নিলেন চন্দ্রনাথ। হোটেলের রেজিস্টারে ছেলেদের নাম লিখলেন সুশীল দত্ত আর অশোক দত্ত। একদিন পরে সেখান থেকে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের শিয়ালদা লজ়। এবার গৌর সাহা নামে রেজিস্টারের ফর্ম ভরতি করলেন চন্দ্রনাথ।
দেবযানী বণিক-এর শ্বশুর চন্দ্রনাথ বণিক
হইচই পড়ে গিয়েছে শহরে ততক্ষণে দেবযানী-হত্যা নিয়ে। পুলিশ সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে পলাতকদের ধরতে। চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীমদের ছবি নিয়ে শহর চষে ফেলছে একাধিক সোর্স। চন্দ্রনাথরা বুঝলেন, বেশিদিন এভাবে পালিয়ে থাকা অসম্ভব। হোটেল থেকে ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ দুই ছেলেকে নিয়ে বেরলেন হাজরার উদ্দেশে, পরিচিত উকিলের বাড়ি। পুলিশ খবর পেল সোর্স মারফত, রাসবিহারী মোড়ের কাছে ৪ ফেব্রুয়ারির দুপুরে আটকানো হল একটি ট্যাক্সি। ভিতরে চন্দ্রনাথ-চন্দন-অসীম। সোজা নিয়ে যাওয়া হল বণিকবাড়ি। যে লাঠি দিয়ে মারা হয়েছিল দেবযানীর মাথায়, উদ্ধার হল ছ’তলার অফিসঘর থেকে। ফাঁস দিতে ব্যবহৃত শাড়ি বেরোল সাততলা থেকে।
পুলিশের কাজই তো অপরাধ-দমন, কিনারা করা ঘটে যাওয়া অপরাধের। তারপর চার্জশিট, বিচারপর্বে সাক্ষ্যদান এবং আরও ‘তারিখ পে তারিখ।’ এবং অনন্ত অপেক্ষা আদালতের আদেশের। রায় পক্ষে গেলে অভিযুক্তের আবেদন উচ্চ থেকে উচ্চতর আদালতে, পুলিশি তদন্তের কাটাছেঁড়া নিয়মমাফিক। এটা করেননি কেন, ওঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়নি কেন, সিজ়ার লিস্টে অমুকের নাম নেই কেন, তমুক তখন কোথায় ছিলেন, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সামনে পড়তে হয় কেস ডায়েরিকে। সামান্যতম খুঁত পেলেই তিরস্কার বরাদ্দ।
সংগতই, তদন্ত তো নিশ্ছিদ্রই হওয়া উচিত। ভুলত্রুটি তো নিষিদ্ধই, মামলা যখন খুনের মতো গুরুতর অপরাধের, প্রশ্ন যখন ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাবাসের। মাননীয় আদালত অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পরই রায় দেন। যা মেনে নিতে হয় নতমস্তকে।