প্রতিশোধ নেওয়াও হল জানুয়ারির শেষাশেষি। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৮৩। বণিকবাড়িতে সেদিন আয়োজন হয়েছে সত্যনারায়ণ পুজোর। বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়স্বজন। মেজোছেলে আশীষ দিন কয়েক হল সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে। এ ছাড়া সবাই উপস্থিত। দেবযানীর দেবর-ননদ, তাঁদের ছেলেপুলে, সব। কাজের লোকের মধ্যে সকালে উপস্থিত যদু, ঊর্মিলা আর শান্তি। চৈতন্য বাড়ি গিয়েছে দিনতিনেক আগে, পুষ্পাও কয়েক দিনের ছুটিতে সুন্দরবনের বাড়িতে।
সকাল ৮-০৫। চন্দনের সঙ্গে হলঘরে কথা-কাটাকাটি হল দেবযানীর। সবার সামনেই চন্দন হিড়হিড় করে টানতে টানতে দেবযানীকে নিয়ে গেলেন বেডরুমে। বেধড়ক মারলেন। কান্না আর আর্তনাদ ছিটকে এল বাইরে। শুনলেন বাড়ির বাকিরা। কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না কেউ, কানে তালা দিয়ে পুজোর সিন্নি নিয়ে আলোচনায় ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সকাল ৮-৩০। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে একরকম জোর করেই হলঘরে বেরিয়ে এলেন দেবযানী। ফোন করলেন বর্ধমানের বাড়িতে। তুললেন দেবদাস, বড়ভাই। সেদিন দত্তবাড়ির পুরুষরা সকাল থেকে খুবই ব্যস্ত একটি জমিজমাসংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে; একটু পরেই কোর্ট-কাছারিতে ছোটাছুটি আছে। দূরভাষে দেবযানী বললেন, ‘এরা আমাকে মেরে ফেলবে! দাদা, তোরা আজই এসে আমাকে নিয়ে যা।’
দেবদাসের মুখচোখ দেখে ফোন নিলেন ধনপতি। ততক্ষণে দেবযানীর থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছেন চন্দ্রনাথ, গালিগালাজ করছেন অকথ্য। ফোন বাবার থেকে আবার নিলেন দেবদাস, বললেন, ‘বোনুকে কিছু করবেন না। আমরা বিকেলের মধ্যে রওনা দিচ্ছি। নিয়ে আসব ওকে। কাকাবাবু, দোহাই আপনার, মারবেন না আর।’ কোনও উত্তর না দিয়ে সপাটে ফোন রেখে দিলেন চন্দ্রনাথ। ঠিক হল, দ্রুত কাজ সেরে সন্ধের আগেই কলকাতায় যাবেন ধনপতি আর দেবদাস। দেবযানীকে নিয়ে আসবেন বাড়িতে। কে জানত, তখনই না বেরিয়ে পড়ে বিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পরিণতি কী ভীষণ মর্মান্তিক হতে যাচ্ছে!
পুজো শেষ হল। সবাই প্রসাদ খেলেন পাত পেড়ে। দেবযানী অভুক্ত থাকলেন, খেতে দেওয়া হল না। পুজোর জায়গার কাছাকাছি আসতেই দেওয়া হল না ‘অলক্ষ্মী’ অপবাদে। অতিথিরা চলে গেলেন দুপুর দুপুর। কল্যাণী আর চিত্রা, বণিকদের বড় আর সেজো মেয়ে, ফিরে গেলেন।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল, বণিকবাড়িতে উপস্থিত চন্দ্রনাথ, ছেলেদের মধ্যে চন্দন-অসীম-নন্দন। মেয়েদের মধ্যে জয়ন্তী, সুমিত্রা আর বিত্রা। দেবযানী নিজের ঘরে। চন্দ্রনাথের স্ত্রী আর মা নিজেদের ঘরে বিশ্রামে। বাচ্চারা আছে নিজেদের ঘরে, নিজেদের মতো। কাজের লোকদের মধ্যে রয়েছে যদু আর শান্তি। ঊর্মিলা দুপুরের কাজ সেরে নীচে গিয়েছেন। আবার আসার কথা সন্ধেবেলায়।
বিকেল ৪-০৫। দেবযানীর ঘরে ঢুকলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন। কিছু পরেই দেবযানীর পরিত্রাহি চিৎকার ভেসে এল ঘর থেকে। যদু এবং শান্তি, দু’জনেরই খুব প্রিয় ছিল বড়বউদি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল দেবযানীর ঘরের দিকে। হলঘরে আটকে দিলেন সুমিত্রা, ‘তোদের কী দরকার এখানে? যা, কাজে যা!’
দেবযানীর আর্তনাদ স্তিমিত হয়ে এল একটু পরে। সাড়ে চারটে নাগাদ রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে যদু দেখল, ওই ঘরে ঢুকছেন অসীম-জয়ন্তী-সুমিত্রা-বিত্রা। কৌতূহল সামলাতে না পেরে ফের যদু আর শান্তি চলে এল ঘরের কাছাকাছি। আবার ধমক সুমিত্রার, ‘তোদের বললাম না নিজের কাজ করতে! যা এখান থেকে।’ যদু আর শান্তি ফিরল রান্নাঘরে। তার আগে অবশ্য দেখা হয়ে গিয়েছে, বড়বউদি ঝুলছে ঘরের সিলিং ফ্যানে। গলায় ফাঁস শাড়ির।
তখন পৌনে পাঁচটা। ধনপতি-দেবদাস কলকাতা রওনা হওয়ার তোড়জোড় করছেন। ফোন বাজল নতুনগঞ্জের বাড়িতে। দেবদাস তুললেন। অন্যপ্রান্তে চন্দ্রনাথ, সকালের রুদ্রমূর্তি বদলে গিয়ে অস্বাভাবিক অমায়িক এখন।
—তোমরা কি রওনা হয়ে গিয়েছ?
—না কাকাবাবু, এই বেরব।
—শোনো, তোমরা আজ এসো না। আমি কাল বর্ধমান যাচ্ছি কাজে। তোমাদের দুর্গাপুরের পেট্রল পাম্পে দেখা করে নেব।
—বোনুকে একবার দেবেন, একটু কথা বলতাম।
—বউমা তো বেরিয়ে গেল একটু আগে চন্দনের সঙ্গে, সিনেমা দেখতে। তোমরা চিন্তা কোরো না, ও ভাল আছে।
ফোন রেখে দেওয়ার পরও খচখচানি একটা থেকেই গেল ধনপতি আর দেবদাসের। ব্যবহারে হঠাৎ এমন ভোলবদল? তারপর ভাবলেন, হতে পারে সকালের মারধরের পর অনুতাপ হয়েছে ওঁদের। মিটমাট হয়েছে সাময়িক। তা ছাড়া কাল তো চন্দ্রনাথ আসছেনই, মুখোমুখি কথা বলে নেওয়া যাবে। অনেক হয়েছে, ঘরের মেয়েকে ফিরিয়ে আনবেন ঘরে।
সন্ধে নেমেছে। বণিকবাড়িতে তখন প্রমাণ লোপাটের ব্যস্ততা। কিন্তু মাথা কাজ করছে না কারও। শান্তি তো রোজ রাত্রে এ বাড়িতে থাকেই, যদুও কখনও কখনও থেকে যায়। শুয়ে পড়ে রান্নাঘরে। দু’জনকেই বলা হল রাত্রে বাইরে শুতে। শান্তি গেল ঊর্মিলার ঘরে, যদু তিনতলায় সিঁড়ির পাশে নিজের রোজকার আস্তানায়। জয়ন্তী ভয় দেখালেন যাওয়ার আগে, ‘কাউকে কিছু বললে কাজ ছাড়িয়ে দেব চুরির বদনাম দিয়ে। না খেতে পেয়ে মরবি।’ ঊর্মিলা সন্ধেবেলা কাজে এসে দেখলেন, কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বেল বাজালেন। ভিতর থেকে চন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কাল আসবি। আজ আর দরকার নেই।’