একটি চিঠির অংশবিশেষ—
শ্রীচরণকমলেষু মা, আমি পাঁচ বছর ধরে সহ্য করছি এদের অত্যাচার। আর পারছি না। আমি এখানে থাকব না আর। তুমি বাবাকে বলো আমাকে নিয়ে যেতে। ওখানে একমাস থাকলে মনটা ভাল হবে। এই চিঠি খুব সাবধানে লিখছি। চৈতন্যদা নিয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বললেও এরা পাশে দাঁড়িয়ে শোনে সব। আমার খুব কান্না পায়। তোমার জামাইও ভাল লোক নয়। খারাপ কথা বলে সব সময়, গায়ে হাত তোলে সবার সামনেই। এভাবে থাকা যায় না। বাবাকে আবার বলো, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
প্রণাম নিয়ো।
তোমাদের বুড়ি।
দেবযানীর সঙ্গে যখন দেখা করতে আসতেন ধনপতি, বসার ঘরে অপেক্ষা করতে হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মিনিটখানেকের দেখা হত পিতা-পুত্রীর, সাক্ষাতের এবং কথোপকথনের সাক্ষী থাকতেন ননদরা।
লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথের ‘দেনা পাওনা’ মনে পড়ে অবধারিত— “রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইতো।”
বাহ্যিক বিচারে দেবযানীর সঙ্গে ‘দেনা পাওনা’-র নিরুপমার মিলের থেকে অমিলই বেশি। নিরুপমার জন্ম অর্থবান পরিবারে নয়। বাবা প্রাণপাত করেছিলেন বকেয়া তিন হাজার জোগাড়ে। নিরুপমার ক্ষয়িষ্ণু মৃত্যু এসেছিল নিজের প্রতি অযত্নে, নিয়ত মানসিক আঘাতে দীর্ণ হতে হতে। দেবযানী বিত্তশালী পরিবারের। খুন হয়েছিলেন। ধনবান পিতাও পারেননি কন্যার শ্বশুরবাড়ির চাহিদা পূরণ করতে।
আপাতভিন্ন প্রেক্ষিত। তবু সার্বিক বিচারে মনে হয়, একটি জায়গায় অক্লেশে মিলেমিশে যান ছাপোষা রামসুন্দর এবং সম্পন্ন ধনপতি। পিতৃহৃদয়ের স্নেহের দোলাচলে। একমাত্র কন্যার মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রণালাঘবের ব্যর্থ অসহায়তায়। আর্থিক সামর্থ্য যেখানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ।
গল্পের নিরুপমার মৃত্যুর পর “এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়”-এর উপায় ছিল রায়বাহাদুরের। বাস্তবের দেবযানীকে হত্যার পর চন্দ্রনাথদের সে-রাস্তা ছিল না। ঘানি টানতে হয়েছিল জেলের। সান্ত্বনা এটুকুই।
ঘটনায় ফিরি। বিরাশির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার দিন কুড়ি আগের কথা। মেজোছেলে বিপ্রদাসের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শিয়ালদার এক আত্মীয়ার বাড়িতে এসে উঠেছেন দত্ত-পরিবারের অনেকে। ধনপতি ব্যবসার কাজে রয়েছেন বর্ধমানেই। বিকেলের দিকে রাইস মিলের ল্যান্ড লাইনে ফোন পেলেন দেবযানীর, ‘বাবা, তোমার জামাই আজ প্রচণ্ড মেরেছে আমায়।’ বলেই কান্না অনর্গল।
ধনপতি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন শিয়ালদায় আত্মীয়ার বাড়ি। স্ত্রীকে বললেন, এক্ষুনি যাও বুড়ির বাড়ি। ছুটলেন দত্ত পরিবারের সদস্যরা। বণিকবাড়ির বসার ঘরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর দেবযানী এলেন। সঙ্গে ননদরা। একান্তে কথা প্রায় বলতেই দেওয়া হল না বাড়ির লোকের সঙ্গে। সুধারানী লক্ষ করলেন মেয়ের ডানহাতের কনুই ফুলে গিয়েছে। কালশিটের দাগ স্পষ্ট। অনুরোধ করলেন চন্দ্রনাথকে, বুড়িকে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হল আর্জি, শেষে বহু অনুনয়-বিনয়ের পর চন্দ্রনাথ বললেন, ‘কয়েকদিন পর ব্যবসার কাজে ত্রিপুরা যাবে চন্দন। তখন নিয়ে যাবেন।’
দেবযানীকে কয়েকদিন পর বর্ধমানে নিয়ে গেলেন ভাই রামদাস। মা-বাবাকে মেয়ে জানাল অত্যাচারিত হওয়ার বিস্তারিত কাহিনি। তখনকার দিনে তো বটেই, আজকের দিনেও এদেশের অধিকাংশ মা-বাবারা যা করে থাকেন এই পরিস্থিতিতে, তা-ই করলেন ধনপতি-সুধারানী। বোঝালেন, আমরা কথা বলব চন্দনের সঙ্গে। সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর বুড়ি।
দেবযানী মা-বাবাকে জানালেন, চন্দ্রনাথ-চন্দন বলেই দিয়েছেন আসার আগে, ধনপতি ওই বকেয়া ধারের ২৫ শতাংশ না দিলে আর কোনও দিন বর্ধমানে আসতেই দেবেন না। ধনপতি বোঝালেন, একসঙ্গে অত টাকা দেওয়া অসম্ভব। দশ লাখ দেবেন বলেছেন তো। পরে আরও চেষ্টা করবেন।
চন্দন এলেন বর্ধমানে দেবযানীকে নিয়ে যেতে। ধনপতি–সুধারানী আপ্রাণ বোঝালেন চন্দনকে, মেয়েকে অত্যাচার না করতে এভাবে। চন্দন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন অভিযোগ শুনে। গালিগালাজ করলেন দেবযানীকে, বললেন আর কখনও বর্ধমানে আসতে দেবেন না। ধনপতি-সুধারানী ভাবলেন, রাগের কথা। সত্যিই যে এটাই এ-বাড়িতে তাঁদের আদরের ‘বুড়ি’র শেষ আসা হতে যাচ্ছে, ভাবেননি দুঃস্বপ্নেও। বেরনোর আগে যখন প্রণাম করছেন দেবযানী, মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধনপতি, তখনও দূরতম কল্পনাতেও ভাবেননি, মেয়ের সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে মাসকয়েক পরে, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
মহালয়ার দিনকয়েক আগে দত্তবাড়ি থেকে পুজোর জামাকাপড় নিয়ে বণিকবাড়ি এলেন দেবদাস। যা তাচ্ছিল্যে ফিরিয়ে দিলেন চন্দ্রনাথ। ফিরে এলেন অপমানিত দেবদাস। ধনপতি বুঝলেন, পুজোটা ভাল কাটবে না বুড়ির।
কাটলও না। অত্যাচার আরও বাড়ল, দেবযানী সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়লেন শ্বশুরবাড়িতে। মাঝ-ডিসেম্বরে কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসার কিছু কাগজপত্র বর্ধমানের কোর্টে জমা দিতে গিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ-চন্দন। আদালতেই দেখা ধনপতিবাবুর বিশ্বস্ত কর্মচারী হৃষিকেশ ঘোষের সঙ্গে। হৃষিকেশকে ডাকলেন চন্দন। নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে, যার মধ্যে বসে আছেন চন্দ্রনাথ। বাকিটা পড়ুন হৃষিকেশের বয়ানে: ‘চন্দ্রনাথবাবু বললেন, তোমার বাবুকে বলবে, আমি প্রতিশোধ নেব। এমন শোধ নেব যে সারা জীবন জ্বলবে। আমি বললাম, আমাকে বলছেন কেন? যা বলার, বাবুকে সরাসরি বলবেন।’