আগে লিখেছি, তবু মনে করিয়ে দিই, বণিক আর দত্ত পরিবারের পারস্পরিক আলাপ-দেখাশোনার পর দেবযানীর বিয়ে হয়েছিল চন্দনের সঙ্গে। ৭৫-এর অগস্টে। বাল্যবিবাহই বলা চলে, দেবযানী তখন সবে চোদ্দো। চন্দন সবে কুড়ি পেরিয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, যৌতুকে কার্পণ্য করেননি ধনপতি। বণিক পরিবারের এ নিয়ে অভিযোগের রাস্তা ছিল না কোনও।
দেবযানী বণিক
বিয়ের প্রথম তিন বছর কোনও সমস্যা ছিল না। সুখী দম্পতির জীবন কাটালেন চন্দন–দেবযানী। ‘বড়বউদি’-র সঙ্গে দেবর-ননদদের সম্পর্কে টাল খায়নি কোথাও। ‘বড়বউমা’-ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি শ্বশুর–শাশুড়ির।
তাল কাটতে শুরু করল ’৭৮-এর জুলাইয়ের শেষাশেষি। ধনপতি এসেছেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। চন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী প্রস্তাব দিলেন, ‘আমাদের সেজো মেয়ে চিত্রার বিয়ে দেব এবার। আপনার বড়ছেলে দেবদাসের সঙ্গেই বিয়েটা হোক, আমাদের একান্ত ইচ্ছে।’ ধনপতি সবিনয়ে জানালেন, ‘এই প্রস্তাব আর কিছু দিন আগে দিলে সম্মত হওয়া যেত। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব নয়। আপনারা তো জানেন দেবদাসের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গিয়েছে গত মাসে আসানসোলের হরিসাধন ঘাঁটির কন্যা কুমকুমের সঙ্গে। অগস্টে বিয়ে। কথার খেলাপ এখন আর করা চলে না।’ বণিক দম্পতি শুনলেন, গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং আর বাক্যব্যয় না করে ভিতরে চলে গেলেন। ধনপতি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, মেয়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এলেন বর্ধমানে।
টানাপোড়েনের পরের ধাপও দেবদাসের বিয়ের সূত্রেই। ধনপতি সপরিবারে এসেছেন ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে। ততদিনে দুই পরিবারেরই একে অন্যের আত্মীয়পরিজনের ব্যাপারে সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই, কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই চন্দ্রনাথ বললেন ‘আচ্ছা, ড. মৃণালকান্তি বিষ্ণু আপনাদের আত্মীয় না?’ ধনপতি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের স্ত্রীর একটিই বোন আছে। ড. বিষ্ণু তাঁর স্বামী। খুবই ঘনিষ্ঠ আমাদের।’ চন্দ্রনাথ শর্ত দিলেন, ড. বিষ্ণুকে বিয়েতে ডাকলে বণিকরা যাবেন না বিয়েতে। ধনপতি জানতে চাইলেন, কেন? জানা গেল, দেবযানীর সঙ্গে বিয়ের আগে, চন্দনের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল ড. বিষ্ণুর ভাগনির সঙ্গে। যেদিন মেয়েকে দেখতে আসার কথা, নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ছ’-সাত ঘণ্টা পর চন্দ্রনাথ গিয়ে জানিয়ে দেন, এ সম্বন্ধ এগোতে আর ইচ্ছুক নন। মেয়েকে না দেখেই। ড. বিষ্ণু বলেন, বিয়ে দেওয়া না-দেওয়া চন্দ্রনাথের ইচ্ছে। কিন্তু এই হেনস্থাটা না করলেই পারতেন। তর্কবিতর্ক-বাদানুবাদ হয়। সেই থেকেই ড. বিষ্ণুর উপর রাগ। ধনপতি শুনলেন সব, কিছু বললেন না।
বিয়ের দিন চন্দ্রনাথ সপরিবারে গিয়ে দেখলেন, ড. বিষ্ণুও আমন্ত্রিত। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ধনপতিকে বললেন, ইচ্ছে করে অপমান করলেন বাড়িতে ডেকে। আর কখনও আপনার মেয়ে বাপের বাড়ি আসবে না। ধনপতি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে না ডাকলে খুবই খারাপ দেখাত। চন্দ্রনাথ কর্ণপাত করলেন না। চলে এলেন বিয়েবাড়ি থেকে।
সংঘাতের তৃতীয় পর্ব বর্ধমানে একটি পুকুর কেনা নিয়ে। ধনপতি পুকুরটি কিনেছিলেন বড় অঙ্কের টাকায়। জানতে পেরে হঠাৎই চন্দ্রনাথ জানান, ওই পুকুরটির জন্য তিনিও বায়না করেছিলেন। তাঁকে দিয়ে দিতে হবে ওই জলাশয়। ধনপতি বললেন, বেশ তো, বায়নানামা দেখান। চন্দ্রনাথ দেখাতে পারলেন না, হালকা বাদানুবাদ হল। দুই পরিবারের মনকষাকষি বাড়ল। যার প্রভাব উত্তরোত্তর পড়তে লাগল দেবযানীর উপর।
দ্রুত পালটে যেতে থাকল শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদদের ব্যবহার। স্বামী চন্দনেরও। শুরু হল কথায় কথায় কটাক্ষ, দুর্ব্যবহার। মাঝেমাঝেই স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে শুরু করলেন চন্দন। দেবযানী বাপের বাড়ি যেতেন প্রতি দু’মাস অন্তর, সেটা কমে দাঁড়াল ন’মাসে- ছ’মাসে একবার। তা-ও বহু কাকুতি-মিনতির পর। মা-বাবাকে চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল বণিকবাড়ির বড়বউয়ের। দেবযানী সহ্য করছিলেন, যেমন করে থাকেন আর পাঁচজন নেহাতই সাদাসিধে, অল্পশিক্ষিতা এবং আর্থিকভাবে স্বামীনির্ভর গৃহবধূ।
পরিস্থিতি জটিলতর হল ’৮২ -র মাঝামাঝি থেকে। বর্ধমানে একটি বিশাল কোল্ড স্টোরেজ কিনলেন চন্দ্রনাথ, ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক কোটি টাকা ধার করে। অন্যান্য ব্যবসায় তখন তুলনামূলক মন্দা চলছে বণিকদের। কোল্ড স্টোরেজটি ঠিকমতো চালু হতেও সময় লাগছিল কিছু। জমছিল না তেমন। এদিকে ব্যাঙ্ক থেকে নিয়মিত তাগাদা আসতে শুরু করল ধারের কিস্তি শোধের, বণিকবাড়িতে পৌঁছল ‘ডিমান্ড নোটিস’। চন্দ্রনাথ চাপ দিতে শুরু করলেন ধনপতির উপর, বকেয়া ধারের ২৫ শতাংশ বহন করতে। ওই পঁচিশ শতাংশ মানে সেই তখনকার দিনেও প্রায় পৌনে এক কোটি। ধনপতি জানালেন, তিনি অপারগ। খুব বেশি হলে দশ লাখ। কোিট খানেক মতো দিয়ে ওঠা তাঁর সাধাতীত। উত্তরে চন্দ্রনাথ ফের মুখ খারাপ করলেন যথেচ্ছ। দুই পরিবারের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটি প্রায় পোঁতাই হয়ে গেল।
দেবযানীর জীবন ক্রমে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠল। বাড়ল চন্দনের মারধরের মাত্রা। শাশুড়ি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তখন। স্বামী-শ্বশুর-দেবর-ননদরা ‘অলক্ষ্মী’ বলে প্রকাশ্যেই ডাকা শুরু করলেন বাড়ির বড়বউকে। ঘুম থেকে উঠলেই রোজ শুনতে হত, এই অলক্ষ্মীটার মুখ দেখতে হল আবার, সারা দিনটা খারাপ যাবে। এর জন্যই কোল্ড স্টোরেজ চালু হল না। বিস্তর কটাক্ষ, গালিগালাজ। বাড়ির পুরনো রাঁধুনি চৈতন্য খুব স্নেহ করতেন দেবযানীকে। তাঁর হাত দিয়ে গোপনে পাঠানো কয়েকটি চিঠিতে ধরা আছে দেবযানীর নিত্যদিনের যন্ত্রণার কাহিনি।