পাঠকহৃদয়ে গোয়েন্দাকাহিনির আকর্ষণ চিরকালীন, লেখা বাহুল্য। হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত-মানিক বা নীহাররঞ্জনের কিরীটি, শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বা সত্যজিতের ফেলুদা, কাহিনি এবং তার কুশীলবরা কল্পনার। লেখক স্বাধীনভাবে রহস্যের ঘনঘটা তৈরি করেন বিবিধ উপাদানে। এই বইয়ের কাহিনিগুলি চরিত্রে ভিন্ন। গোয়েন্দারা বাস্তবের, চরিত্ররা রক্তমাংসের এবং কাহিনি ‘গল্প হলেও সত্যি’-র শ্রেণিভুক্ত। যা ঘটেছিল আর যেভাবে ঘটেছিল, সেই লক্ষ্মণরেখার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কোনও।
কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন, পত্তন ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে, ১৮৬৮ সালে। সর্বজনবিদিত তথ্য, কলকাতা পুলিশকে তুলনা করা হত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে, দেশব্যাপী এতটাই সুনাম ছিল গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারদের। এবং এই সুনাম অর্জিত হয়েছিল অগণিত জটিল মামলার রহস্যভেদে ধারাবাহিক পেশাদারি দক্ষতায়। সেই মামলাগুলির থেকে বারোটি বেছে নিয়ে এই বইয়ে সংকলিত রইল তদন্তের নেপথ্যকথা। প্রতিটি মামলাই খুনের। প্রতিটিই কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে দিকচিহ্ন, হয় অপরাধীর বেনজির ভাবনায় বা পদ্ধতিতে, নয় তদন্তকারী অফিসারের নৈপুণ্যের মানদণ্ডে, কিংবা অভিযুক্তকে শাস্তিদানে বিজ্ঞানমনস্কতার বিরল প্রয়োগে।
আলোচিত মামলাগুলির সময়কাল পাঠক লক্ষ করবেন নিশ্চিত । বিংশ শতকের তিরিশের দশকের ঘটনা দিয়ে শুরু। শেষ মাত্র দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডে। যা প্রমাণ করে, কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদের দক্ষতার ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’, এবং বাস্তবের ফেলু-ব্যোমকেশদের ধারাবাহিক কীর্তিতেই লালবাজার হয়ে উঠেছে গোয়েন্দাপীঠ।
জটিল খুনের মামলার তদন্ত অনেকাংশে তুলনীয় টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে। একদিনের ম্যাচ নয়, কুড়ি-বিশের বিনোদন তো নয়ই। ঘটে যাওয়া অপরাধের কিনারা করা সিঁড়ির প্রথম ধাপ মাত্র। সাক্ষ্যপ্রমাণ সংহত করে ঠাসবুনোট চার্জশিট পেশ করার পরও অসমাপ্ত থাকে কাজ। দীর্ঘ বিচারপর্বে অভিযুক্তের শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারলে তবেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় তদন্তের। রোম্যান্স-রোমাঞ্চ বর্জিত এই পথ পাড়ি দিতে অশেষ ধৈর্যের প্রয়োজন হয় তদন্তকারী অফিসারের। প্রয়োজন হয় শত প্রতিকূলতাতেও ক্রিজ়ে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার অধ্যবসায় এবং মনোসংযোগের। পাঁচ দিনের ক্রিকেটের মতো।
বাস্তবের সত্যান্বেষীদের সেই কর্মকাণ্ডই এই বইয়ের আধার। বাস্তবের অপরাধের তদন্তের আখ্যান বাংলা ভাষায় একেবারেই অমিল, এমন নয়, কিন্তু তদন্তপদ্ধতির সামগ্রিকতার প্রামাণ্য দলিল চোখে পড়ে না বড় একটা। সে অভাব যদি কিছুটাও দূর করতে পারে বইটি, তদন্তশিক্ষার্থীরা যদি কিছুমাত্রও উপকৃত হন আগামীতে, পরিশ্রম সার্থক।
লেখাগুলির সময়কাল গত বছরের জুলাইয়ের শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। যে সময়টা কলকাতা পুলিশের অ্যানুয়াল পরীক্ষা, যে সময়টা শারদোৎসবের। পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যেও লেখা গিয়েছে নগরপালের সোৎসাহ প্রশ্রয়ে। তাঁকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর ধৃষ্টতা নেই, শ্রদ্ধা জানাই।
ধন্যবাদ প্রাপ্য ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শ্রীঅতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের, যিনি মামলাগুলির তথ্যতালাশে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ধন্যবাদ অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নীহারেন্দু রায়কে, যিনি আক্ষরিক অর্থেই কলকাতা পুলিশের ‘সিধু জ্যাঠা’, যিনি সরবরাহ করেছেন এই বইয়ে ব্যবহৃত দুর্মূল্য নথিপত্র। স্নেহভাজন সহকর্মী ইন্দ্রজিৎ দত্ত-কে ধন্যবাদ, ম্যানুস্ক্রিপ্ট টাইপ করায় হাসিমুখে অক্লান্ত থাকার জন্য।
বিনিদ্র রাতে যখন লিখেছি পেশার ব্যস্ততম সময়ে, পারিবারিক দায়দায়িত্ব একপ্রকার বিসর্জন দিয়েই, আগাগোড়া পাশে থেকেছে স্ত্রী ঋতুপর্ণা, যার সমর্থন না পেলে এই বই দিনের আলো দেখত না।
ছোটবেলা থেকে এদিক-ওদিক অকিঞ্চিৎকর লেখালেখি যতটুকু, দিশারী ছিলেন মা-বাবা। কেউই বেঁচে নেই। তবে যেখানেই থাকুন, জানি, পড়ছেন।
১ জানুয়ারি, ২০১৮
কলকাতা
১.০১ এভাবেও মেরে ফেলা যায়!
[পাকুড় হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার এম এল রহমান]
উফফ, কী একটা ফুটিয়ে দিয়ে চলে গেল!
পাঞ্জাবির হাতা ততক্ষণে গুটিয়ে ফেলেছেন বছর কুড়ির যুবক। পরীক্ষা করছেন ডান হাতের উপরের দিকের ক্ষতচিহ্ন। পিন ফোটালে যেমন হয়। জ্বালা করছে বেশ।
সে বহুকাল আগের কথা। বেলা আড়াইটে তখন। হাওড়া স্টেশনের গড়পড়তা দুপুর দ্রুত রওনা দিচ্ছে বিকেলের দিকে। ভারী ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে। ভিড়ে হাঁসফাঁস স্টেশন-চত্বর। যাত্রীদের লটবহর কাঁধে কুলিদের ‘থোড়া সাইড দিজিয়েগা ভাইসাব!’ মন ভাল বা খারাপ করে দেওয়া কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ির। ইঞ্জিন থেকে চলকে ওঠা ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ঊর্ধ্বমুখী। অমুক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে তমুক ট্রেন একটু পরেই পাড়ি দেবে গন্তব্যে, ঘোষণা মিনিটে মিনিটে।
সন ১৯৩৩। তারিখ ২৬ নভেম্বর। স্টেশনের চলতিফিরতি ভিড়ের নজর কাড়ছে পাকুড়ের জমিদারবাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডের ঘরে ফেরার আয়োজন। পাত্রমিত্র-অমাত্যের দঙ্গল এসেছে স্টেশনে। ছোটখাটো শোভাযাত্রাই বলা চলে। অমরেন্দ্রর সঙ্গে যাবেন সহোদরা বনবালা। বিশেষ ঘনিষ্ঠ কমলাপ্রসাদ পান্ডে, অশোক প্রকাশ মিত্র এবং আরও অনেকে এসেছেন বন্ধুকে ছাড়তে। বৈমাত্রেয় দাদা বিনয়েন্দ্রও উপস্থিত।