লেপ-কম্বল-তোশক ডাঁই করা। সরানো হল।
খাটের নীচেও প্রচুর জামাকাপড়ের জঙ্গল। একদম ঠাসাঠাসি। যা টেনে বার করা হল একে একে এবং ভিতর থেকে বেরোল এক তরুণীর মৃতদেহ। শাড়ি-ব্লাউজ শরীরে। ফুলে উঠেছে দেহ, শুরু হয়েছে পচন। ‘Rigor Mortis’ (মৃত্যুর কিছু ঘণ্টা পর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের শক্ত হয়ে যাওয়া) বাসা বেঁধেছে দেহে। নাকমুখ থেকে রক্তের স্রোত বয়ে শুকনো দাগের চেহারা নিয়েছে শাড়িতে। গলায় ফাঁসের দাগ।
হলঘরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহিলাকে ডাকা হল। চেনেন এঁকে? সমস্বরে উত্তর, না! ঘুম থেকে তোলা হল বছর বারোর কিশোরকে, চেনো এঁকে? ছেলেটি কেঁদে ফেলল নিমেষে, অস্ফুটে বেরোল একটাই শব্দ— বউদি!
—কী নাম বউদির?
—দেবযানী। দেবযানী বণিক।
খবর পেয়ে গভীর রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন পুলিশকর্তারা। ডিসি হেডকোয়ার্টার, ডিসি ডিডি, ডিসি সাউথ, হোমিসাইড শাখার প্রায় সবাই। তদন্তের চাকা ঘুরতে শুরু করল। তদন্তভার নিলেন হোমিসাইড তৎকালীন শাখার সাব-ইনস্পেকটর সুজিত সান্যাল।
গৃহবধূ-হত্যার খবর জানাজানি হতেই প্রবল প্রতিক্রিয়া শুধু কলকাতায় নয়, রাজ্যজুড়ে। এমন চর্চিত মামলা কমই হয়েছে কলকাতা পুলিশের শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসে। তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আনন্দবাজার-যুগান্তরের প্রথম পাতায় আলোচিত হয়েছে দেবযানী-নিধনের রোজনামচা। যা অব্যাহত থেকেছে তীব্র টানাপোড়েনের বিচারপর্বেও। ঘৃণ্য অপরাধের দিকচিহ্ন হিসেবে আজও রয়ে গিয়েছে ওই অভিশপ্ত বহুতল, যাকে স্থানীয় মানুষ চিনতেন ‘বণিকবাড়ি’ নামে। গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে, এলাকার ভূগোল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, এমন কাউকে এখনও পরিচিতজন দেখিয়ে দেন ওই এগারোতলার মাল্টিস্টোরিড, ‘এটাই সেই বণিকবাড়ি!’
খবরের কাগজের সংবাদ
ওই তিন মহিলার পরিচয় কী, গ্রেফতার হওয়ার পর কী বললেন, বাড়ির পুরুষরাই বা কীভাবে পালালেন, আর ধরা পড়লেন কোথায় কখন, সে বিবরণে পরে আসছি।
তা ছাড়া, এটি তো ‘whodunnit’ নয় যে খুনি কে, জানার কৌতূহল থাকবে। সকলেরই মনে থাকবে, স্বামী-শ্বশুর-দেবর-ননদরা যুক্ত ছিলেন খুনে। চন্দ্রনাথ-চন্দন, এই দুটি নাম অনেকের মনেও আছে নিশ্চিত। তবে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ঘরসংসারে আদ্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ এক নেহাতই সহজসরল গৃহবধূকে, কতটা নির্মমতার সাক্ষী ছিল মৃত্যুর আগের ও পরের ঘটনাপ্রবাহ, সে কাহিনিও কম নাটকীয় নয়। বস্তুত, নারীনির্যাতনের এক কলঙ্কময় দলিল। সবিস্তার লিখতে গেলে অণু-উপন্যাসের আকার নেবে, যথাসাধ্য সংক্ষেপে পেশ করলাম দেবযানী-হত্যার ইতিবৃত্ত।
বণিকবাড়ি
শুধু বিত্তবান বললে কম বলা হয়, প্রভূত সম্পদশালী ছিল গড়িয়াহাটের বণিক-পরিবার। ব্যবসা মূলত চা-বাগানের। এ ছাড়াও বহুমুখী ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ ফুলেফেঁপে ওঠা। গড়িয়াহাটের এগারোতলা ‘বণিকবাড়ি’ তৈরি করেছিলেন চন্দ্রনাথ বণিক।
একতলা থেকে চারতলার ফ্ল্যাটগুলি ভাড়া দিয়েছিলেন বা বিক্রি করেছিলেন। কোনওটা আবাসিকদের, কোনওটা সরকারি–বেসরকারি সংস্থাকে। নিজে থাকতেন সপরিবারে পাঁচতলায়, প্রায় দশ হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। ছ’তলা এবং সাততলার ফ্ল্যাট নিজের অধিকারে রেখেছিলেন। আট থেকে এগারো, উপরের চারটি তলা ছিল নির্মীয়মান অবস্থায়।
বণিক পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। চন্দ্রনাথ মধ্যপঞ্চাশ পেরিয়ে ষাট-ছুঁইছুঁই। স্ত্রী কিছুকাল হল অসুস্থ। মা বেঁচে আছেন। তিনিও শয্যাশায়ীই বলা চলে, ওষুধবিষুধ-পরিবৃত জীবন। নয় সন্তানের জনক চন্দ্রনাথ। পাঁচ কন্যা, চার পুত্র। বড়মেয়ে কল্যাণী বিবাহিতা, কসবায় শ্বশুরবাড়ি। তার পরের দু’জন, জয়ন্তী আর চিত্রার বিয়ে হয়েছে যথাক্রমে শিলিগুড়ি আর শ্রীরামপুরে। সুমিত্রা এবং বিত্রা অবিবাহিতা এখনও, থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গে। বড়ছেলে চন্দন বণিক, ১৯৭৫–এর অগস্টে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে বর্ধমানের নতুনগঞ্জ নিবাসী ব্যবসায়ী ধনপতি দত্তের একমাত্র মেয়ে দেবযানীর সঙ্গে। তিন সন্তান চন্দন-দেবযানীর। দুই ছেলে বাবু আর টাবু, মেয়ে মামণি। খুবই ছোট এখনও, শৈশবের চৌকাঠ পেরতে ঢের দেরি। মেজোছেলে আশীষ বিবাহিত, স্ত্রীর নাম রূপা। একটি মেয়ে আছে ওঁদের, সে-ও দুধের শিশুই প্রায়। সেজো অসীম অবিবাহিত। সবচেয়ে ছোট বারো বছরের নন্দন, ক্লাস সেভেন।
বাড়িতে কাজের লোক বলতে জনাপাঁচেক। মাঝবয়সি চৈতন্য, দীর্ঘদিন রান্নাবান্না করেন বণিকবাড়িতে। চারতলার ল্যান্ডিং-এর পাশে একটি ছোট ঘরে থাকেন। যদু নামের যুবক, থাকেন তিনতলায় সিঁড়ির পাশের ঘরে। কাজ বলতে চন্দ্রনাথের সঙ্গে সকালে বাজার যাওয়া, বাসনপত্র ধোওয়া, টুকটাক হাজারো ফাইফরমাশ খাটা। ঊর্মিলা, সকাল-বিকেল ঠিকের কাজ করেন। ঘর মোছা, কাপড় কাচা, রান্নায় সাহায্য ইত্যাদি। পুষ্পা, বয়স কুড়ির এদিক-ওদিক, দেখাশোনা করেন চন্দন-দেবযানীর বাচ্চাদের। আর শান্তি, বারো বছরের কিশোরী। দেখভাল করার দায়িত্ব আশীষ-রূপার একমাত্র মেয়ের।
বর্ধমানের দত্ত পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও প্রয়োজন এখানে। খুবই বর্ধিষ্ণু এঁরা। ধনপতি দত্তের রাইস মিল আছে, আছে পেট্রল পাম্পও। অনেকগুলি বসতবাড়ি আছে বর্ধমানে, জমিজমাও যথেষ্ট। আছে মাছের ভেড়িও। স্ত্রী সুধারানী বর্তমান। তিন ছেলে, দেবদাস, বিপ্রদাস এবং রামদাস। এক মেয়ে, দেবযানী। সবার ছোট, বাড়ির সকলে চোখে হারায়। দাদারা ডাকে ‘বোনু’ বলে, মা-বাবার আদরের ডাক ‘বুড়ি’।