অন্য কোথাও নয়, স্কটল্যান্ডে! কী আশ্চর্য সমাপতন!
১.০৪ বণিকবাড়ির অন্তরমহলে
[দেবযানী বণিক হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার সুজিত সান্যাল]
—থানা থেকে আসছি। দরজাটা খুলুন প্লিজ়!
রাত সোয়া দশটা তখন। কোলাপসিবল গেট পাঁচতলার ফ্ল্যাটের বাইরে। তালা দেওয়া। গেটের পিছনে কাঠের দরজা। যা খোলাই ছিল প্রায় অর্ধেক, পুলিশের ডাকাডাকিতে বন্ধ হয়ে গেল দড়াম।
লোক আছে ভিতরে, একাধিক, বোঝার জন্য বুদ্ধি খাটানোর দরকার হয় না কোনও। নারীকণ্ঠ-পুরুষকণ্ঠ, ফিসফিসানি দিব্যি শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকেও। ফের ডাক দেওয়া হল, ‘গড়িয়াহাট থানার ওসি হীরেন্দ্রলাল মজুমদার বলছি, দরজাটা খুলুন একবার।’
ভিতরে যাঁরা ছিলেন, নিরুত্তর। ফিসফিস কথাও শোনা যাচ্ছে না আর। উলটে ওসি-র আওয়াজে নিভে গেল ভিতরের আলো, যেটা জ্বলছিল এতক্ষণ। ডাকাডাকি, দরজায় ধাক্কাধাক্কি আরও বেশ কিছুক্ষণ। ধৈর্যের সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওসি চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিলেন, ‘শেষ বারের মতো বলছি। যে বা যাঁরা ভিতরে আছেন, দরজা খুলুন। না হলে ভেঙে ঢুকতে বাধ্য হব, খুলুন!’
তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। ওসি খবর দিলেন দমকলে। অনুরোধ করলেন গেট এবং দরজা ভাঙার জন্য যা যা দরকার, সব নিয়ে দ্রুত চলে আসতে। ২৬, গড়িয়াহাট রোডের পাঁচতলায়। খুব বেশি হলে মিনিটদশেক। যন্ত্রপাতি নিয়ে পৌঁছলেন দমকলকর্মীরা।
লোহার মজবুত কোলাপসিবল গেট। কাঠের দরজাটিও নেহাত পলকা নয়। ভাঙতে সময় লাগল কিছু। ঢুকলেন ওসি-সহ থানার অফিসাররা, দমকলের আধিকারিকরা এবং সাক্ষী হিসাবে চার স্থানীয় বাসিন্দা। যাঁরা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে।
এমনিতেই গড়িয়াহাট চত্বর রাতভর আলোঝলমল। ফুটপাথ এখানে বদল হয় না মধ্যরাতে। দোকানপাটের অধিকাংশ সাড়ে ন’টা–দশটার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেলেও অন্তত মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকেই টুকটাক পান-সিগারেটের ঠেক। দক্ষিণে গোলপার্ক-ঢাকুরিয়া, উত্তরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি-পার্ক সার্কাস। পুবে বিজন সেতু-বালিগঞ্জ স্টেশন, পশ্চিমে রাসবিহারী-চেতলা। মানুষজনের যাতায়াত চলতেই থাকে বেশি রাত পর্যন্ত। গাড়িঘোড়ার স্রোতও তলানিতে ঠেকতে ঠেকতে গড়িয়ে যায় মাঝরাত্তির।
এহেন গড়িয়াহাট মোড় থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের বহুতলের সামনে পুলিশের গাড়ি, দমকলের সাইরেন সাড়ে দশটা নাগাদ। মাত্রাছাড়া নয়, কিন্তু কৌতূহলী ভিড়-জটলা একটা তৈরি হলই। বাড়তি ফোর্স পাঠানো হল লালবাজার কন্ট্রোল রুম থেকে।
ফ্ল্যাটের ভিতরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বিশাল হলঘরে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল তিন মহিলাকে, দাঁড়িয়ে আছেন জড়সড়। চোখেমুখে টেনশন আর আতঙ্কের জ্যামিতি। ওসি-র পুলিশি ধমকে আরও কুঁকড়ে গেলেন ওঁরা, ‘কী ব্যাপারটা কী? দরজা খুলছিলেন না কেন? রাতদুপুরে কি আমরা গল্পগুজব করতে এসেছি এখানে?’
গড়িয়াহাট থানা, কেস নম্বর ৪৯, তারিখ ৩০/০১/৮৩। ধারা ১২০বি/৩০২/২০১/৩৪ আইপিসি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, খুন, প্রমাণ লোপাট এবং একই অপরাধের উদ্দেশ্যে একাধিকের যৌথ পরিকল্পনা।
সেই তুমুল চাঞ্চল্যকর মামলার বিবরণ। সবে কুড়ির কোঠায় পা দেওয়া এক গৃহবধূর নৃশংস খুন শ্বশুরবাড়িতে। দেবযানী বণিক হত্যা মামলা।
আমাদের কন্ট্রোল রুমে ফোনটা এসেছিল দশটা নাগাদ। আজও অজানা, কে করেছিলেন। বর্তমান সময় হলে বোঝা যেত সহজেই। কন্ট্রোল রুমের সব ফোনেই এখন সিএলআই লাগানো রয়েছে। তখনকার সময়ে ছিল না। ফোনে পুরুষকণ্ঠ জানিয়েছিল, গড়িয়াহাটের বণিকবাড়িতে লোক পাঠান তাড়াতাড়ি। ওদের বড়বউকে সবাই মিলে খুন করেছে। দেরি করলে বডি সরিয়ে দেবে।
থানা থেকে হেঁটে গেলে খুব বেশি হলে তিন মিনিটের পথ, গাড়িতে তার অর্ধেক। কন্ট্রোল রুম জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই ছুটেছিল পুলিশ।
নামেই ফ্ল্যাট, আয়তনের বিচারে প্রায় ফুটবল মাঠ। ঢুকেই প্রশস্ত করিডর, দৈর্ঘ্যে প্রায় একশো মিটার। প্রস্থেও নেহাত কম নয়। করিডরের দু’ধারে সার দিয়ে অনেকগুলি ঘর। যার অধিকাংশেই লাগোয়া বারান্দা। এক কোণে একটি মন্দিরও রয়েছে কাচ দিয়ে ঘেরা। পাঁচতলা থেকে ছ’তলায় সরাসরি যাওয়ার দরজা রয়েছে। আর ছ’তলা থেকে সাততলায় পৌঁছনোরও। চালু হল ঘরগুলির তল্লাশি। ছ’তলা-সাততলা তালাবন্ধ। পাঁচতলার ফ্ল্যাটের একটি ঘরে তিনটি বাচ্চা ঘুমোচ্ছে অঘোরে। অন্য একটিতে এক বৃদ্ধা মহিলা, তিনিও ঘুমন্ত। একটিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা, দৃশ্যতই অসুস্থ। শুয়ে আছেন চোখ বুজে। আর একটি ঘরে বারো বছরের এক ঘুমন্ত কিশোর। রান্নাঘরে তালাচাবি।
করিডরে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘বাইরে থেকে তো আওয়াজ পাচ্ছিলাম পুরুষকণ্ঠের, ওঁরা কোথায় গেলেন?’ তিনজনই নিরুত্তর, ঠোঁটে যেন কেউ সাইলেন্সার লাগিয়ে রেখেছে। পরের প্রশ্ন, এ বাড়ির বড়বউয়ের নাম কি দেবযানী বণিক? কোথায় উনি? ডাকুন। মুখে এখনও কুলুপ মহিলাত্রয়ীর। ততক্ষণে দুর্গন্ধ পেতে শুরু করেছেন অফিসাররা। পেশার প্রয়োজনে যে গন্ধ ডাক্তার বা পুলিশের অতি পরিচিত। পচতে থাকা মৃতদেহের।
উত্তর-পূর্ব কোণের ঘরটিতে ঢুকতেই গন্ধ তীব্রতর ঠেকল, নাকে রুমাল উঠে এল সবার। শূন্য ঘর, পরিপাটি বিছানা। লাগোয়া বারান্দা। যেখানে ঢোকার মুখেই বাচ্চাদের একটি বড় লোহার দোলনা আড়াআড়ি ভাবে ফেলা রয়েছে। বেশ ভারী, সরানো হল ধরাধরি করে। বারান্দায় একটি ফোল্ডিং খাট। তার উপর স্তূপাকার