—পাথরটা কোথায়?
—এই যে স্যার…
একটা প্লাস্টিকের মোড়ক থেকে যেটা বার করলেন ওসি, সেটা পাথর নয়। খুব বেশি হলে একটু বড় সাইজ়ের থান ইট। আগের খুনগুলোয় একটাতেও ইটের ব্যবহার হয়নি। বারোটা খুনেরই অস্ত্র ছিল বড় পাথর, অন্তত পনেরো থেকে কুড়ি কেজি ওজনের। এই ইট দিয়ে মাথায় মারলে আঘাত লাগবে ঠিকই, কিন্তু প্রাণহানি একেবারেই নিশ্চিত নয়। তা হলে?
ফের জেরা শুরু করেন গোয়েন্দাপ্রধান।
—কলকাতায় কী করতে এসেছিলেন? পোস্টিং তো বললেন রানিবাঁধে। অফিসের কাজে এসেছিলেন?
—হ্যাঁ স্যার… তবে সেটা আসল কারণ নয়।
—তবে?
—ভাষণ শুনতে এসেছিলাম।
—ভাষণ মানে? কার ভাষণ?
—সুভাষবাবুর। ওঁর পরের সভাটা কবে কোথায় বলবেন প্লিজ়?
—সুভাষবাবু মানে?
—সুভাষবাবু স্যার! সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজি!
—নেতাজির ভাষণ?
—হ্যাঁ স্যার, শিয়ালদা স্টেশনের সামনে আজ নেতাজির সভা ছিল তো! অনেকদিনের ইচ্ছে, সামনে থেকে ওঁর ভাষণ শুনব। জীবন সার্থক হল আজ স্যার। ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও…… আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব…’ শুনতে শুনতে অন্য জগতে চলে যাচ্ছিলাম স্যার। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
—বেশ তো! তা ভাষণ শেষ হওয়ার পর ফিরে গেলেন না কেন? শিয়ালদার ফুটপাথে রাত কাটাবেন বলে ঠিক করে এসেছিলেন?
—না না, তা কেন হবে স্যার? মিটিং শেষই তো হল রাত সাড়ে আটটায়। ট্রেনের গণ্ডগোল ছিল আজ। ফিরতে পারলাম না। ভাবলাম ভোরে ফিরব। রাতটা থেকে যাই রাস্তায়। এদিক-সেদিক ঘুরে ফুটপাথে শুয়ে পড়লাম। সবে ঘুমটা এসেছে, গোঁ গোঁ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি এক মহিলা উঠে বসে আমাকে ঠেলছে। এমন আওয়াজ করছে মুখ দিয়ে, বাকিরাও জেগে গেল। আমি তখন থামানোর জন্য পাশে পড়ে থাকা ইট তুলে ভয় দেখাচ্ছিলাম, যাতে চুপ করে যায়…
কথার মাঝপথে ফের থামিয়ে দেন ওসি এন্টালি, ‘গল্প দিচ্ছে স্যার। মহা শয়তান! নেতাজির ভাষণ শুনতে এসেছিল! ইয়ার্কি মারার জায়গা পায়নি! কানের গোড়ায় দুটো দিলেই…’
ওসি এন্টালির দিকে এবার কড়া দৃষ্টিতে তাকান গোয়েন্দাপ্রধান, ‘আপনি থামবেন? আমি কথা বলছি তো!’
কালীপদকে নিয়ে লালবাজার থেকে গাড়ি রওনা দিল শিয়ালদায়, যেখান থেকে ওসি এন্টালি ধরেছিলেন ‘হাতেনাতে’। ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়েছে উল্কাগতিতে, ওই মাঝরাতেও। ‘স্টোনম্যান’ ধরা পড়েছে! গোয়েন্দাপ্রধানের নেতৃত্বে যখন টিম পৌঁছল শিয়ালদায়, ভিড় জমে গেছে সাংবাদিকদের। ভিড় জমে গেছে অন্তত শ’তিনেক কৌতূহলী জনতার। কন্ট্রোল রুম থেকে বাড়তি ফোর্স পাঠানো হয়েছে পরিস্থিতি আন্দাজ করে।
তথ্যতালাশে জানা গেল, কালীপদ মিথ্যে বলেননি। সহজেই চিহ্নিত করা গেল সেই মহিলাকে, যাকে মারতে গিয়েছিলেন কালীপদ। স্থানীয়রা জানালেন, বছর তিরিশের ওই মহিলা জন্মাবধি মূক ও বধির। সম্পূর্ণ অচেনা এক পুরুষ পাশে শুয়ে আছেন, এটা হঠাৎ আবিষ্কার করার পর আতঙ্কে গোঁ গোঁ করতে থাকেন। সেই আওয়াজে অন্য দু’-তিনজনেরও ঘুম ভেঙে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে মিলে গেল কালিপদর বয়ান।
‘নেতাজি’-র সভা? সেদিন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সভা সত্যিই ছিল শিয়ালদা চত্বরে। শেষ হয়েছিল রাত আটটার পর। এবং সত্যিই সেদিন যান্ত্রিক গোলযোগে রাত সোয়া এগারোটা অবধি শিয়ালদা লাইনে ট্রেন বন্ধ ছিল।
লোকটা তা হলে গল্প বানাচ্ছে না? স্রেফ মনোবিকার গ্রস্ত? ভোরেই দুটো টিম রওনা দিল রায়দিঘিতে কালীপদর বাড়িতে এবং রানিবাঁধের অফিসে। বিস্তর খোঁজখবর করে যা জানা গেল, এরকম।
যখন যুবক, সবে চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন থেকেই মাথার ব্যামো দেখা দিয়েছিল কালীপদর। কখনও একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করতেন, কখনও আবার চলে যেতেন অন্য দুনিয়ায়। ‘হ্যালুশিনেশনস’ হত, টাইমমেশিনে পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে কখনও ভাবতেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য, কখনও বা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী।
ডাক্তারবদ্যি দেখিয়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। উন্নতি হয়নি বিশেষ। অফিসে হয়তো এক সপ্তাহ মন দিয়ে কাজ করলেন আর পাঁচজন সহকর্মীর সঙ্গে, হঠাৎ পরের সপ্তাহে কাউকে কিছু না বলে দুম করে চলে গেলেন কলকাতা বা অন্য কোথাও। বাড়ির এবং অফিসের লোকেরা ক্রমে মানিয়ে নিয়েছিলেন এই খ্যাপাটে স্বভাবের সঙ্গে।
অফিসের হাজিরাখাতা খুঁটিয়ে দেখা হল গত ন’মাসের। খোঁজ নেওয়া হল গ্রামের বাড়িতেও, খুনগুলোর সঙ্গে দিন মিলিয়ে মিলিয়ে। এবং দেখা গেল, আগের খুনগুলোর দিন হয় অফিস করেছিলেন, নয় বাড়িতে ছিলেন। কোনওভাবেই কলকাতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না।
আরও নিঃসংশয় হতে নেওয়া হল পায়ের ছাপ। মিলল না বেকবাগানের খুনের জায়গার থেকে সংগৃহীত ফুটপ্রিন্টের সঙ্গে। না, ইনি নন। স্টোনম্যান অধরাই।
এবং অধরাই রয়ে গেল কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে দগদগে ক্ষতচিহ্ন রেখে। তেরো নম্বর খুনটা আর হয়নি, কে জানে কীভাবে, হঠাৎই থেমে গিয়েছিল রাতের সিরিয়াল-কিলিং। ‘স্টোনম্যান’ কে, সেই রহস্যকে রহস্যাবৃতই রেখে।
কে ছিল স্টোনম্যান? ধরতে পারিনি আমরা। জানতে পারিনি আমরা। যেমন জানতে পারিনি, ‘স্টোনম্যান’ না ‘স্টোনমেন’? এক, না একাধিক? একক বিকার, না কোন চক্রের অঙ্গুলিহেলন? তবে স্বাভাবিক বুদ্ধি যা বলে, তার সঙ্গেই সহমত ছিলেন তদন্তকারী অফিসারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘স্টোনম্যান’ একজনই ছিল। খুনগুলো করে মনোবিকার চরিতার্থ করা ছাড়া কোনওরকম জাগতিক লাভ হয়নি ঘাতকের। একাধিক সদস্যবিশিষ্ট কোনও চক্রের জড়িত থাকার সম্ভাবনা এই জাতীয় সিরিয়াল-হত্যায় ক্ষীণতমই।