ক্ষমা-টমা চেয়ে যখন ভদ্রলোককে বিদায় করছি চা খাইয়ে, তখনও তরুণ সহকর্মীর চোখেমুখে অবিশ্বাসের জ্যামিতি। এ-ও নয়?’
এ তো নয়ই, এখনও পর্যন্ত সন্দেহের বশে আটক হওয়া কেউই যে নয়, প্রমাণ মিলল বারো নম্বর খুনে। যেটা ঘটল এগারো নম্বরের ঠিক পাঁচদিন পরে, ২৬ ফেব্রুয়ারি। এবং এবার সমস্ত হিসেব উলটে দিয়ে ঘটনাস্থল তৃতীয় এবং নবম খুনের ঘটনাস্থলের গা ঘেঁষেই, শিয়ালদা ফ্লাইওভারের সাবওয়ের কাছে। ফের মুচিপাড়া থানা এলাকায়। একই জায়গায় সাধারণত বারবার আঘাত হানে না সিরিয়াল কিলাররা। সেই ট্র্যাডিশন বদলে দিল স্টোনম্যান। নিহত এবার এক পনেরো-ষোলোর হতভাগ্য কিশোর, যার পেশা বলতে ছিল স্টেশন-চত্বরে ভিক্ষাবৃত্তি। খুনের সময় মধ্যরাতের কিছু পরে। পদ্ধতি এক। খুনের অস্ত্রও এক। মৃতদেহের কয়েক হাত দূরে পড়ে থাকা রক্তলাল পাথর।
দুঃসময় চললে যা হয়, উটকো উপদ্রবেরও শেষ ছিল না তখন। এক রাতে হেস্টিংস থানা এলাকায় যেমন রাত আড়াইটে নাগদ দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে ওঠার মুখে এক যুবককে বসে থাকতে দেখল ‘পেট্রোলিং টিম’। বয়স তিরিশের নীচে। পরে আছেন দামি টি-শার্ট, ব্র্যান্ডেড জিন্স। সুদর্শন চেহারা। সঙ্গে একটা ব্যাগ।
—এখানে কেন? এত রাতে কী করছেন?
—স্টোনম্যান-কে ধরতে বেরিয়েছি। সপ্তাহে অন্তত দুটো রাতে নিয়মিত বেরই। ইউ ক্যান কল মি ‘stoneman catcher’.
বোঝো! স্টোনম্যানকে ধরতেই নাকানিচোবানির একশেষ। তার উপর স্টোনম্যানকে ধরতে বেরনো শখের গোয়েন্দাদেরও ধরতে হলে তো দুর্গতির বত্রিশকলা পূর্ণ। যুবকের সঙ্গের ব্যাগে পাওয়া গেল স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। এ ছাড়াও নাইলনের দড়ি-ক্ষুর-ছুরি, রুল, চওড়া বেল্ট এবং আরও কিছু ওষুধ টুকিটাকি।এগুলো কেন?
—বাহ্! স্টোনম্যানকে ধরতে গেলে এগুলো লাগবে না? তা ছাড়া স্টোনম্যানের আক্রমণে আহত কারও চিকিৎসাতেও তো লাগতে পারে।
কী আর বলার থাকে এর পর, নাম-ঠিকানা জেনে গাড়িতে তুলে দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা ছাড়া? বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, যুবক মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন বেশ কিছুকাল। যুবকের মা-কে হাতজোড় করে হেস্টিংসের ওসি বলে এলেন, ‘মাসিমা, আমরা খুবই চাপের মধ্যে আছি। ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাতে বাড়িতেই রাখার চেষ্টা করবেন প্লিজ়।’ আর যুবককে দিয়ে এলেন সহৃদয় পরামর্শ, ‘আমরা আর একটু চেষ্টা করি স্টোনম্যানকে ধরতে, না পারলে আপনার সাহায্য চাইব, কেমন?’
ন’মাসের মধ্যে এক ডজন খুন। কিনারাসূত্র অধরা। চেষ্টা তো হয়েছে সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে। কী করার থাকতে পারে আর? কিন্তু কে আর শুনতে চায় ব্যর্থ চেষ্টার ইতিবৃত্ত, কে শুনতে চায় ‘ভাল খেলিয়াও পরাজিত’-র কষ্টকথা? আসল তো ‘ফলেন পরিচয়তে।’ পুলিশের কাজ অপরাধীকে ধরা। সেটাই যখন পারছে না ন’মাস ধরে, কার সময় আছে ক্লান্তি-শ্রান্তি-পরিশ্রমের সাতকাহন শোনার?
রাজ্য প্রশাসন যখন পৌঁছে গিয়েছে অস্বস্তির চরমসীমায়, যখন কলকাতা পুলিশের সর্বস্তরে ঢালাও রদবদলের আলোচনা জমাট বাঁধছে রাইটার্সের অন্দরমহলে, তখনই, মার্চের প্রথম সপ্তাহের এক মধ্যরাতে ওসি এন্টালির ওয়ারলেস বার্তা ছড়িয়ে পড়ল লালবাজারের কন্ট্রোল রুম মারফত, ‘স্টোনম্যান কট রেড হ্যান্ডেড নিয়ার শিয়ালদা, বিইং ব্রট টু লালবাজার!’
স্টোনম্যান ধরা পড়েছে হাতেনাতে? অবশেষে? বারো পেরিয়ে তেরো নম্বর খুনের বেলায় খেল খতম? আনলাকি থার্টিন?
ফোন পাওয়া মাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে লালবাজার ছুটলেন গোয়েন্দাপ্রধান সহ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সমস্ত অফিসার। জানানো হল সিপি-কে। যিনি জানালেন, যত দ্রুত সম্ভব রওনা দিচ্ছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছিলেন ওসি হোমিসাইড। গোয়েন্দাপ্রধানকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ওসি, ‘আসুন স্যার, বসুন।’
বসেন না গোয়েন্দাপ্রধান। একদৃষ্টে স্থির তাকিয়ে থাকেন চেয়ারে বসা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই স্মিতহাস্য মাঝারি গড়নের লোকটির দিকে। এ-ই স্টোনম্যান? এই লোকটা? যে শুধু লালবাজার নয়, পুরো শহরের ঘুম কেড়ে নিয়েছে গত নয় মাসে, সেই জুন থেকে? শান্তভাবে প্রশ্ন করেন গোয়েন্দাপ্রধান।
—কী নাম আপনার?
—কালীপদ দাস।
—বাড়ি কোথায়?
—রায়দিঘি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
—কী করেন?
—রাজ্য সরকারের কর্মচারী স্যার।
—কোন ডিপার্টমেন্ট?
—ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ।
—পোস্টিং কোথায়?
—রানিবাঁধ, বাঁকুড়া। কিন্তু স্যার, আপনারা আমাকে ধরে এনেছেন কেন? কী করেছি আমি?
আর থাকতে পারেন না ওসি এন্টালি, ডিসি-ডিডি-র জেরার মাঝেই চেঁচিয়ে ওঠেন উত্তেজিতভাবে, কী করেছেন মানে? জানেন না কী করেছেন, জানেন না কী করতে যাচ্ছিলেন? হাতেনাতে ধরেছি স্যার, আর এখন বলছে কী করেছি…
হাতের ইশারায় ওসি-কে থামান গোয়েন্দাপ্রধান।
—অত উত্তেজনার কিছু নেই। কীভাবে ধরলেন এঁকে?
—স্যার, রোজকার মতো শিয়ালদা স্টেশনের আশেপাশে টহল দিচ্ছিলাম। ঘুরে দেখছিলাম ফুটপাথগুলো। বৈঠকখানা বাজারের কাছের ফুটপাথে চোখে পড়ে এঁকে। এক মহিলা গোঁ গোঁ করে চিৎকার করছিলেন, আর ঠিক তার পাশে শুয়ে থাকা এই ভদ্রলোক একটা পাথর দিয়ে মারতে যাচ্ছিলেন মহিলার মাথায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরেছি। আর এখন বলছে, কী করেছি?