নয় নম্বর খুনটা করতেও মাসখানেকের বেশিই সময় নিল স্টোনম্যান। নজরদারি আর রাতপাহারা জারি থাকলেও যখন স্বাভাবিক নিয়মেই শৈথিল্য এসেছে কিছুটা, ঠিক তখন, নভেম্বরের ২৬ তারিখ। ফের শিয়ালদা ফ্লাইওভারের সাবওয়েতে, নীলরতন সরকার হাসপাতাল থেকে ক্রিকেটবল-ছোড়া দূরত্বে। পাথরের আঘাতে ফের এক বছর চল্লিশের অজ্ঞাতপরিচয় ফুটপাথবাসীর ভবলীলা সাঙ্গ।
ফের শুরু তেড়েফুঁড়ে নজরদারি, এবং এবার দু’মাস কোনও সাড়াশব্দ করল না স্টোনম্যান। নিজের উপস্থিতি জানান দিল বছর পার করে, ১৯৯০-এর ২৯ জানুয়ারি, আচমকা। প্রফুল্ল সরকার ষ্ট্রিটে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসের কাছের ফুটপাথে শায়িতা এক মহিলার মাথা চুরমার হয়ে গেল পাথরের আছড়ানিতে। মৃতার বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, নাম শান্তি মান্না। স্বামী মারা গিয়েছেন বেশ কিছুদিন হল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, পেশায় যৌনকর্মী। বেশিরভাগ রাত ফুটপাথেই কাটাতেন।
স্টোনম্যানের ধরা পড়ার আশা তখন প্রায় একরকম ছেড়েই দিয়েছে পুলিশ। মিডিয়াও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পুলিশি ব্যর্থতা নিয়ে নিউজ়প্রিন্ট খরচা করতে করতে। ‘কে স্টোনম্যান?’, ‘কেন স্টোনম্যান?’ এসব প্রশ্নের থেকে তখন ঢের বেশি কৌতূহল পরের খুনটা নিয়ে। এরপর কবে-কখন-কোথায়?
খুন নম্বর এগারোয় চমকে দিল স্টোনম্যান। প্রথম দশটা খুন হয়েছিল মধ্য কলকাতায়। নজরদারি কেন্দ্রীভূত ছিল বউবাজার-মুচিপাড়া-বড়বাজার-পোস্তা-জোড়াসাঁকো-এন্টালি অঞ্চলে। একাদশতম খুনে নিজের অপরাধ-বৃত্ত বিস্তৃত করল স্টোনম্যান। পা রাখল দক্ষিণ কলকাতায়। দশম খুনের ঠিক একুশ দিন পরে। ২০ ফেব্রুয়ারি।
বেকবাগানের মোড়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের পশ্চিম ফুটপাথে আবিষ্কৃত হল আরেক হতভাগ্যের দেহ। যথারীতি ভারী পাথর দিয়ে মাথাটা থেঁতলানো। নিহতের স্থানীয় নাম ‘মাস্তান’, বয়স বছর চল্লিশের কাছাকাছি। ভিক্ষা করেই দিনযাপন করতেন।
আগের দশটা খুনের সঙ্গে তফাত বলতে, পদচিহ্ন রেখে গেছে স্টোনম্যান। খুনে ব্যবহৃত পাথরটা পড়ে ছিল মৃতদেহ থেকে চার গজ দূরে।একটা ড্রেনের মধ্যে। খুনের পরে আততায়ী স্পষ্টতই পাথরটাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এবং সরানোর সময়ই মৃতের রক্তস্রোতে পা পড়ে। ফুটপ্রিন্টস সংগ্রহ করতে ছুটে এলেন বিশেষজ্ঞরা বাঁ পায়ের ছাপ পাওয়া গেল তিনটে। ডান পায়ের ন’টা। পায়ে জুতো ছিল না। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল খানিক। বাঁ পায়ের তিনটে ছাপ পড়েছে অস্পষ্ট, বাকি মিলিয়ে গেছে। ডান পায়ের ছাপগুলো অক্ষত এবং মোটামুটি ‘ডেভেলপযোগ্য’।
বিশেষজ্ঞরা পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে দুটো সিদ্ধান্তে এলেন। এক, স্টোনম্যানের চেহারা মাঝারি গড়নের হওয়ারই সম্ভাবনা। খুব লম্বা-চওড়া সম্ভবত নয়। দুই, ঘাতকের ডান পায়ের বুড়ো আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা।
কিন্তু এটুকু ‘লিড’ আর কতটাই বা কাজে আসবে? ধরা পড়লে তবেই না পায়ের ছাপ মিলিয়ে নিঃসংশয় হওয়ার প্রশ্ন।
দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের পোড়খাওয়া অফিসাররা, অসংখ্য জটিল মামলার সমাধান যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে করে এসেছেন ঈর্ষণীয় পেশাদারি দক্ষতায়। এবং সর্বগ্রাসী হতাশা মনের দখল নিলে একটা পর্যায়ের পর যা স্বাভাবিক, যুক্তি-বুদ্ধিকে লাস্ট বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়ে সামনের সারিতে কেউ কেউ জায়গা দিলেন অন্ধ বিশ্বাসকে।
ওসি হোমিসাইড স্বয়ং ডেকে পাঠালেন এক পরিচিত জ্যোতিষীকে। জানতে চাইলেন, কবে হতে পারে এই যন্ত্রণামুক্তি? কবে ধরা পড়বে স্টোনম্যান? কেমন দেখতে হতে পারে স্টোনম্যান? কেমন হতে পারে চালচলন?
জ্যোতিষী বিস্তর গণনা-টননা করে রায় দিলেন, সুসংবাদ আসন্ন। স্টোনম্যান ধরা পড়বে শীঘ্রই। জানালেন আরও, স্টোনম্যান বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটে। এমন হাঁটার ধরন যাঁদের রাতের শহরে, তাদের চিহ্নিত করতে পারলে রহস্যভেদ নাকি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
বিচারবুদ্ধিকে বন্ধক রাখলে যা ঘটতে পারে, তার বিবরণী থাকুক এক প্রত্যক্ষদর্শী অফিসারের বয়ানে।
‘নিয়মমাফিক সারারাত টহল দিয়ে ফিরছিলাম লালবাজারে। সঙ্গী এক সাব-ইনস্পেকটর আর দুই কনস্টেবল। গাড়ি যখন আকাশবাণী পেরিয়ে এগোচ্ছে রাজভবনকে ডান হাতে রেখে, হঠাৎ সঙ্গী সাব-ইনস্পেকটরের পরিত্রাহি চিৎকারে হতচকিত হয়ে ব্রেক কষল ড্রাইভার। ‘আরে, থামান থামান। ওই তো!’
‘ওই তো!’ মানে? মানে বোঝার আগেই এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে তরুণ সহকর্মী, হাইকোর্টের সামনে শরৎ বসুর স্ট্যাচুর দিকে আপ্রাণ দৌড়ে জাপটে ধরেছে একজনকে। যাঁর মাঝারি গড়ন, গায়ে চাদর। এবং যিনি অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে চিলচিৎকার জুড়েছেন, ‘বাঁচাও, মার ডালা……!’
কী হল ব্যাপারটা? গাড়ি থেকে নেমে আমরাও ছুটলাম। কাছে গিয়ে দেখি, তরুণ সাব-ইনস্পেকটরের চোখেমুখে উত্তেজনা ঠিকরে বেরচ্ছে, হাঁফাতে হাঁফাতে বলছে, ‘পেয়েছি স্যার! এই ব্যাটাই স্টোনম্যান! কেমন বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছিল! আমি ঠিক খেয়াল করেছি। বারে বারে ঘুঘু তুমি…’
থামিয়ে দিয়ে বকের মতো পা ফেলে হাঁটা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। এঁকে তো চিনি!
পোদ্দার কোর্টের কাছে একটা হার্ডওয়ারের দোকান চালান এই অবাঙালি ভদ্রলোক। নিতান্ত নিরীহ মানুষ। সকালে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। দোষের মধ্যে, একটু লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটেন। বকের মতো।