—আমার যদিও মনে হচ্ছে একজনই, তবে তুমি যা বলছ, নট এন্টায়ারলি ইমপসিবল। যা অবস্থা এখন, সব অপশনই মাথায় রেখে এগোতে হবে। যেখানে যেখানে খুনগুলো হয়েছে, তার কাছাকাছি তো কোনও পাথরের স্তূপ ছিল না। যে মেরেছে, পাথরটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বা আগে থেকে কাছেপিঠে এনে রেখেছে।
—ফুটপাথ বলে আরও সমস্যা হচ্ছে স্যার। ধুলোবালি আর ‘একস্টারন্যাল এলিমেন্টস’-এ একটা কেসেও কোনও ডেভেলপ করার মতো ফুটপ্রিন্টসও পাওয়া যায়নি। পেলে অন্তত এই ‘দুনিয়া মালিকের’ সঙ্গে মেলানো যেত। কোথাও কোনও চিহ্ন রেখে যাচ্ছে না লোকটা।
—যা নেই, তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আপাতত এই মহম্মদ এক্রামের একটা ‘সাইকোলজিক্যাল এগজ়ামিনেশন’ দরকার। মনস্তত্ত্ববিদদের পরামর্শ নেওয়াটাই জরুরি হয়ে পড়ছে।
—রাইট স্যার। কালই ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তাতেও কি ডেড শিয়োর হওয়া যাবে… আই মিন… যতক্ষণ না নিজে কনফেস করছে…
—দেখাই যাক… আর মনে রেখো, ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘The proof of the pudding is in the eating’… ডেডশিয়োর হওয়ার ওটাই উপায়। এই ‘দুনিয়া মালিক’-ই যদি স্টোনম্যান হয়, তা হলে সাত নম্বর খুনটাই লাস্ট খুন। আর হবে না। যদি হয়, বুঝতে হবে, এক্রামকে মিথ্যে সন্দেহ করছি আমরা।
—স্যার…
নগরপালের ঘর থেকে বেরনোর পর গোয়েন্দাপ্রধানের কানে বাজতে থাকে কথাগুলো। এ-ই যদি স্টোনম্যান হয়, তা হলে শেষ খুনটাই ‘শেষ’। না হলে বুঝতে হবে…
না হলে যা বুঝতে হবে, সেটাই বোঝা গেল অক্টোবরের ১৯ তারিখ। সপ্তম খুনের এক মাস আট দিন পরে যখন গোয়েন্দাপ্রধানের কাঁচা ঘুমে ছেদ ঘটাল মধ্যরাতের ফোন।
—ক্রিং ক্রিং!!
—নমস্কার স্যার, আবার!
—মানে?
—আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজের কাছে স্যার… সিইএসসির ট্রান্সফর্মার আছে একটা…
—তুমি শিয়োর? আই মিন মোডাস অপারেন্ডি…
—হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্যার… যা শুনলাম… জাস্ট দা সেম…
—তা হলে আশঙ্কাই সত্যি হল? গত এক মাসের খচখচানিটাই দেখা দিল রূঢ়তম বাস্তব হয়ে? ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া?’
‘ফিরিয়া যে এসেছে’, মৃতদেহ দেখার পর সন্দেহ ছিল না আর একচিলতেও। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তার ত্র্যহস্পর্শ ফের গ্রাস করল লালবাজারকে। এবার?
তদন্তের বিজ্ঞান বলে, অপরাধীকে ধরতে হলে অপরাধীর মনের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করো। এবং ভাবার চেষ্টা করো অপরাধীর মতো করে। কে স্টোনম্যান? ‘কে’, সেটা পরে হবে। আগে চিন্তা করা দরকার, কী ভাবে?
স্টোনম্যানের ভাবনা কোন খাতে বইছে, সেটা নিয়ে মাথা খাটানো বেশি জরুরি। কীভাবে পুলিশকে, ফুটপাথবাসী রাত-জাগা জনতার চোখে ধুলো দিয়ে নিরীহ মানুষকে মেরে যাচ্ছে লাগাতার? আগে থেকেই জরিপ করে নিচ্ছে, পুলিশ প্রহরা কোথায় কোথায়? তারপর খুঁজে নিচ্ছে নজরদারিহীন নির্জন কোনও ফুটপাথ? এটা বুঝে গেছে, হাজার হাজার ফুটপাথবাসীকে সারারাত পাহারা দেওয়া পুলিশের পক্ষে অসম্ভব? সেই মতো শিকার খুঁজে নিচ্ছে? এবং শিকার চিহ্নিত করার পর সম্ভাব্য শিকারের আশেপাশেই কি শুয়ে থাকছে পাথর নিয়ে? আর রাত গভীর হলে আঘাত হানছে নির্মম নৃশংসতায়?
আক্ষরিক অর্থেই দিশেহারা পুলিশ তখন যেভাবে পারল চেষ্টা করল অপরাধীর মনের হদিশ পাওয়ার। এবং ঘটতে থাকল অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড কিছু। স্টোনম্যান মামলার তদন্তের সঙ্গে শুরু থেকে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন, এমন একজন অফিসারের স্মৃতিচারণ তুলে দিলাম।
‘তখন পাগল পাগল লাগছিল নিজেদের। যার যা মনে হচ্ছে করছিলাম। রাতের পর রাত জাগছি, ভোরে ফিরছি। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সারাদিন অফিস করে ফের রাতে বেরিয়ে পড়ছি। মাথা কাজ করছিল না বেশিরভাগ সময়। আট নম্বর খুনের পর এক রাতে যখন টহল দিচ্ছি শিয়ালদা স্টেশন এলাকার আশেপাশের ফুটপাথে, হঠাৎ দেখলাম চাদরমুড়ি দিয়ে একজন মুখ বার করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তাকানোটা সন্দেহজনক। আরে এ ব্যাটা জেগে আছে কেন? ওভাবে আশেপাশে তাকাচ্ছেই বা কেন?
আমি করলাম কী, সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম চাদরমুড়ি দেওয়া লোকটার সামনে। চাদরটা টেনে সরিয়ে দিলাম গা থেকে। টর্চ ফেললাম মুখে। ‘কে রে তুই?’ জিজ্ঞেস করার আগেই থমকে গেলাম চেহারাটা দেখে। আরে! এ তো বহুদিনের চেনা মুখ। ব্যাচমেট। একই সঙ্গে পুলিশ ট্রেনিং কলেজে কাটিয়েছি এক বছর। তারপর কর্মসূত্রে কলকাতা পুলিশে দীর্ঘদিনের সহকর্মী, অভিন্নহৃদয় বন্ধু। এ তো ওসি মুচিপাড়া! এখানে কী করছে?
—কী আর করব বল? আমার এলাকাই তো স্টোনম্যানের বেশি পছন্দ। কী আর করব? শুয়ে আছি ফতুয়া-পায়জামা পরে। যদি ধরতে পারি হাতেনাতে! শুধু আমি নয়, বাঁদিকে চার-পাঁচটা লোকের পরে আমার এক সাব-ইনস্পেকটর শুয়ে আছে।
—এভাবে সারারাত থাকবি?
—উপায় কী আর? চাকরিটা বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করছি আর কী! তবে শুধু আমি নয়। মৌলালিতে যা, দেখবি ওসি এন্টালিও শুয়ে আছে ফুটপাথে।
—অ্যাঁ! সে কী রে!
—আরে ভাই হ্যাঁ! তুইও গিয়ে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ফুটপাথে অন্যদের সঙ্গে শুয়ে পড়। রাস্তায় ঘুরে তো কিছু হল না, হবেও না আর। তাই স্ট্র্যাটেজি পালটেছি।’
স্ট্র্যাটেজি অবশ্য স্টোনম্যানও পালটে ফেলছিল নিঃশব্দে। চৌঠা জুন থেকে এগারোই সেপ্টেম্বরের মধ্যে সাতটা খুন। গড় ধরলে প্রতি দু’সপ্তাহে একটা। মুচিপাড়ায় অষ্টম খুনটা ঘটেছিল সপ্তমের একমাস আটদিন পরে, যখন পুলিশ সামান্য স্বস্তির অবকাশ পেয়েছে, এবং মনে করছে স্টোনম্যান পর্বের হয়তো ইতি।