তিন, স্রেফ উত্তেজনা আহরণের জন্য খুন। বিজাতীয় আনন্দের জন্য খুন। অন্যকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট করার জন্য খুন। লক্ষ্য যেখানে অন্য কিছু নয়, ‘থ্রিল’। সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং নিরপরাধ কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে শিরা-উপশিরায় বাড়তি অ্যাড্রিনালিনের আমদানি।
আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে ‘সিরিয়াল কিলার’ বলতেই প্রথম যে নামটা উঠে আসে অবধারিত, ‘জ্যাক দ্য রিপার’! যিনি ১৮৮৮ সালে লন্ডনে অন্তত পাঁচজন দেহপসারিণীকে খুন করে শিরোনামে চলে এসেছিলেন রাতারাতি। হইচই পড়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে।
নাম আরও করা যায়। যেমন উনিশ শতকের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরপর ন’টা খুন করা H. H. Holmes কিংবা মোটামুটি সমসময়েই ফ্রান্সে ১১ জন মহিলা এবং শিশুকে উপর্যুপরি খুনের নেপথ্যে থাকা সিরিয়াল-ঘাতক Joseph Vacher, যিনি কুখ্যাত হয়েছিলেন ‘The French Ripper’ নামে।
এ তো গেল বিদেশের কথা। ভারতে? রমন রাঘবের কথা উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে
যাবে এই লেখা। ১৯৬৬ থেকে ৬৮–র মধ্যে মুম্বই শহরতলি এবং পুনেতে দু’দফায় অন্তত পঁয়ত্রিশটা খুনের পর গ্রেফতার হয়েছিল এই রমন রাঘব। প্রতিটি খুনেই শিকার ছিল হয় ফুটপাথবাসী, নয় বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্রতম শ্রেণিভুক্ত কেউ। চূড়ান্ত আতঙ্ক গ্রাস করেছিল বাণিজ্যনগরীকে। ধরা পড়ার পর মনোবিদরা রমনের সঙ্গে বহু সময় কাটিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, সে সংশোধনের অযোগ্য মনোবিকারগ্রস্ত। মানসিক অসুস্থতার কথা ভেবেই নিম্ন আদালতের ফাঁসির রায় উচ্চতর কোর্টে বদলে গিয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাসে।
সিরিয়াল-কিলারের আতঙ্ক ফের মুম্বইয়েই ফিরে এসেছিল আটের দশকের মাঝামাঝি। ১৯৮৩ থেকে ’৮৬-র মধ্যে বারোটা খুন হয়েছিল একই কায়দায়। ফুটপাথবাসীদের মাথায় পাথর মেরে। ধরা যায়নি সেই ‘স্টোনম্যান’-কেও। এক ডজন খুনের পর আচমকাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিধননাট্য। বারো নম্বরই শেষ।
তা হলে কি সেই ‘স্টোনম্যান’-ই আবির্ভূত ফের কলকাতায়? গোয়েন্দা বিভাগের টিম পাড়ি দিল মুম্বইয়ে, তখনকার খুনগুলোর বিষয়ে আলোচনা করতে। এবং এতসবের মধ্যেই সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ দেখতে পেল লালবাজার। রাতের শহরের টহলদারি টিমগুলোর একটা শিয়ালদা স্টেশনের কাছ থেকে আটক করল এক সন্দেহভাজনকে।
সন্দেহভাজন তো প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আটক হচ্ছিল। এক্ষেত্রে উৎসাহিত হওয়ার কারণ? ভবঘুরে প্রকৃতির লোকটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ঘুরছিলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের পাশে ইতস্তত। পুলিশ আটকেছিল।
—নাম কী আপনার?
—দুনিয়া মালিক।
—মানে?
—দুনিয়া মালিক। মানে দুনিয়ার মালিক।
—ইয়ার্কি মারার জায়গা পাননি? আসল নামটা বলুন।
—নামের আবার আসল-নকল? মা-বাবা নাম রেখেছিল মহম্মদ এক্রাম। কিন্তু ওটা নকল নাম। আসল নাম দুনিয়া মালিক।
—বেশ তো দুনিয়া মালিক, বাড়ি কোথায়? এত রাতে এখানে কেন?
—পুরো দুনিয়াটাই তো আমার বাড়ি। নিজের বাড়িতে ঘুরতে পারব না সাব?
অফিসাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। ব্যাটা হয় মাথায়-ছিট আধপাগলা, নয় সাতসেয়ানার ক্যাপ্টেন। আন্দাজে ঢিল ছোড়েন এক সাব-ইনস্পেকটর।
—বেশ, বুঝলাম। রাতে থাকেন কোথায়? ঘুমোন কোথায়?
—ঘুমোই না স্যার, ফুটপাথে ফুটপাথে ঘুরি স্যার। দুনিয়ার মালিকের দুনিয়ায় কত লোকের মাথার ওপর ছাদ নেই, রাতে ঘুরে ঘুরে দেখি।
—ঘুরে ঘুরে দেখেন আর পাথর দিয়ে খুন করে বেড়ান, তাই তো?
ভাবলেশহীন উত্তর আসে।
—আমি দুনিয়ার মালিক। কেন খুন করতে যাব স্যার? তবে ফুটপাথে এইভাবে যারা রাত কাটায়, সেটা কোনও বাঁচা হল স্যার? ইয়ে ভি কোই জিন্দেগি হ্যায়?
—গাড়িতে উঠুন।
ভোররাত থেকে লালবাজারে শুরু হল ‘দুনিয়া মালিক’-কে ম্যারাথন জেরা। কথাবার্তা কখনও এলোমেলো, অসংগতিপূর্ণ, কখনও সামান্য হলেও স্বাভাবিক। জানা গেল, বিহারের সীতামারি জেলার বাসিন্দা এই মহম্মদ এক্রাম। কলকাতায় এসেছিলেন বাবার সঙ্গে বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে। বাবা মহম্মদ ঈশা দিনমজুরের কাজ করতেন এদিক-ওদিক। বাবা মারা যাওয়ার পর ভবঘুরে জীবনযাপন। এই লোক স্টোনম্যান?
জেরাপর্ব শেষে নগরপাল বৈঠক সারেন গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে।
—তোমার ‘গাট ফিলিং’ কী বলছে?
নগরপালের প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দাপ্রধানকে দ্বিধাগ্রস্ত শোনায়।
—কনফেস তো করেনি এখনও। তবে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়ার মতো জায়গাতেও নেই আমরা। আরও ডিটেইলড ইন্টারোগেশন দরকার স্যার……
—সে তো দরকারই। মেন্টালি আনস্টেবল একটু, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সিরিয়াল কিলারদের ‘মেন্টাল ইনস্টেবিলিটি’ থাকেই নানা ধরনের। এই যে ‘দুনিয়া মালিক’ বলছে, একটা ‘ইমাজিনড সেন্স অফ পাওয়ার’ থেকে বলছে।
—আর সেই ‘পাওয়ার’ বা ক্ষমতা ফলানোর বোধ থেকেই এভাবে পরের পর খুন….
—অসম্ভব নয়… একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
—কিন্তু স্যার… লোকটার চেহারাটা খেয়াল করেছেন?
—হ্যাঁ, আই ওয়াজ় কামিং টু দ্যাট… ওই ল্যাকপেকে চেহারায় পনেরো-কুড়ি কেজি ওজনের পাথর তুলে আছড়ে মারবে… এটা ঠিক…
—কিন্তু এমনও তো হতে পারে, আমরা স্টোনম্যান-স্টোনম্যান ভাবছি, আসলে এটা একটা গ্যাং। স্টোনম্যান নয়, ‘স্টোনমেন’। একাধিক লোক মিলে প্ল্যান করে কাজটা করছে।