কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেকটর শ্রীঅনিল ব্যানার্জির উপর পড়ল তদন্তভার। কিনারা সম্পূর্ণ হয়েছে নিঃসংশয়, অপরাধ স্বীকার করেছে অভিযুক্ত। কিন্তু প্রমাণ? ভারতীয় সাক্ষ্য আইন (Indian Evidence Act)-এর ২৭নং ধারায় অভিযুক্তের বয়ান অনুসরণে উদ্ধার হয়েছে কঙ্কাল। মিলেছে ছুরি (weapon of offence)। মৃতের আত্মীয়স্বজন চিহ্নিত করেছেন ধুতি-শার্ট, চুনের কৌটো। কী বাকি থাকে আর?
বাকি যে মূল কাজটাই, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছিলেন অনিলবাবু। কঙ্কালটি যে পঞ্চমেরই, তা তর্কাতীত প্রমাণ করা। পরামর্শ করলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের সঙ্গে। যাঁরা জানালেন দ্ব্যর্থহীন, অভিযুক্ত যা-ই কবুল করুক পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে, অপরাধের সঙ্গে সংস্রব অস্বীকার করবেই আদালতে, যেমন করে নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে। এবং বেকসুর খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যদি না সন্দেহাতীত প্রমাণ পেশ করা যায় যে কঙ্কালটি পঞ্চমেরই দেহের। এখনও পর্যন্ত প্রমাণস্বরূপ যা রয়েছে হাতে, তা নিশ্চিত চিহ্নিতকরণের পক্ষে অপর্যাপ্ত। সন্দেহের আনুকূল্য অভিযুক্ত পাবেনই, ধরে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই সমীচীন।
অনিলবাবু প্রয়াত হয়েছেন বেশ কিছুকাল হল। তাঁর তৎকালীন অধীনস্থ অফিসারদের মধ্যে যাঁরা এখনও জীবিত, তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায় আদ্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষটির চরিত্রবৈশিষ্ট্যের। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের নিস্পৃহ নিধন করায়ত্ত ছিল না হয়তো, কিন্তু মনোভঙ্গি ছিল গাভাসকরের। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও স্থিতধী সংকল্পে। পরিকাঠামোর সহায়তায় সাফল্যে বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শৃঙ্গস্পর্শে ছিলেন একমুখী। নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস ছিল, দেশবিদেশের অপরাধ-তদন্তের বহমান ধারাটি সম্পর্কে সদাসচেতন থাকতেন পেশাগত উৎকর্ষের তাগিদে।
চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন, কীভাবে হবে কঙ্কালের শনাক্তকরণ? বকেয়া টাকা ফেরত না পাওয়ার আক্রোশে একটা জলজ্যান্ত লোককে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করল, খালাস পেয়ে যাবে? অবসরে অনেকটা সময় কাটাতেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে, তৎকালীন ইন্টারনেটহীন সময়কালে জ্ঞানবৃদ্ধিতে গ্রন্থাগারই ছিল মুখ্য ভরসাস্থল। বিদেশে কোথায় একটা এমন মামলা হয়েছিল না? কোথায় যেন পড়েছিলেন? অনিল ছুটলেন আলিপুরে। জাতীয় গ্রন্থাগার যদি দেখাতে পারে কাঙ্ক্ষিত আলোর দিশা।
দিশা মিলল বিস্তর বইপত্র নেড়েচেড়ে। এই তো! এই কেসটাই তো খুঁজছিলেন, “The Buck Ruxton ‘Jigsaw murders’ case”।
মামলার সংক্ষিপ্তসার এই। বাক রাক্সটনের জন্ম ভারতে। নাম ছিল বখতিয়ার রুস্তমজি রতনজি হাকিম। ডাক্তারি পাশ করে চলে যান ইংল্যান্ডে। ওকালতনামা করে নাম পরিবর্তন করেছিলেন। চিকিৎসক হিসেবে রোগীমহলে যথেষ্ট সমাদৃতই ছিলেন। স্ত্রী ইসাবেলা এবং মহিলা গৃহকর্মী মেরি রজারসনকে নিজের ল্যাঙ্কাশায়ারের বাড়িতে কুপিয়ে খুন করেছিলেন। ১৯৩৫-এর সেপ্টেম্বরে।
রাক্সটন নিজে চিকিৎসক ছিলেন, প্রয়োগ করেছিলেন অধীত বিদ্যা। দুটি দেহেরই অগুনতি খণ্ড করেছিলেন। শনাক্ত করার যাবতীয় শরীরচিহ্ন মুছে দিতে চেষ্টা করেছিলেন এক এক করে। খণ্ডগুলি পার্সেলে মুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের একটি ব্রিজের নীচে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, দেহাংশ যদি পরে আবিষ্কৃতও হয়, শনাক্তকরণ যেন হয় অসম্ভব। মোটিভ? যৌন-ঈর্ষা জনিত সন্দেহপ্রবণতা। রাক্সটনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ইসাবেলা জড়িয়ে পড়েছেন গভীর পরকীয়ায়। তীব্র অশান্তি হত স্বামী-স্ত্রীর। একাধিকবার সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলেও গিয়েছিলেন ইসাবেলা। প্রতিবারই ফিরিয়ে এনেছিলেন রাক্সটন। অবিশ্বাস-সন্দেহ-বাদানুবাদ অবশ্য অব্যাহতই থেকে গিয়েছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি ইসাবেলার হত্যায়। এবং ঘটনার সাক্ষী থাকায় গৃহকর্মী মেরিকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ায়।
ঘটনার পক্ষকাল পরে পার্সেলে মোড়া দেহাংশ আবিষ্কার করেন কয়েকজন পথচারী। ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি তদন্তকারীদের মনে করিয়ে দিয়েছিল ‘Jigsaw Puzzle’-এর কথা। নানা টুকরো জুড়ে একটি পূর্ণ ছবি তৈরি করার খেলা। মামলাটির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘Jigsaw Murders’।
একঝাঁক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অসাধ্যসাধন করেছিলেন। দুটি দেহের অসংখ্য খণ্ডাংশ জুড়ে পূর্ণাবয়বে ফিরিয়ে এনেছিলেন, ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট অধ্যাপক জন গ্লেইস্টার এবং অ্যানাটমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেমস কুপার ব্র্যাশের নেতৃত্বে। ফরেনসিক প্রমাণের এহেন অভিনব এবং সফল প্রয়োগ হয়নি অতীতে। বিশ্বে সেই প্রথম ‘Photographic Superimposition’ ব্যবহৃত হয়েছিল তদন্তে। যা নিশ্চিত চিহ্নিত করেছিল মৃতা দুই মহিলাকে, অকাট্য প্রমাণে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ডা. রাক্সটন। ফাঁসি হয়েছিল।
কী প্রবল চর্চিত হয়েছিল এ মামলা, কী তীব্র প্রভাব ফেলেছিল জনমানসে, উদাহরণ দিই। ‘Red sails in the sunset’ গানটি তখন তুমুল জনপ্রিয় বিশ্বজুড়ে। বিখ্যাত গীতিকার জিমি কেনেডি লিখেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে পোর্টস্টুয়ার্ট (Portstewart) শহরে বাড়ি ছিল কেনেডির, সমুদ্র থেকে অদূরে। প্রায়ই দেখতে পেতেন একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরী। সেই দৃশ্যই গানটির অনুপ্রেরণা। রাক্সটন মামলা নিয়ে গান পর্যন্ত বেঁধে ফেলা হয়েছিল ‘Red sails…’-এর ছায়ায়।