—তাতে লাভ তো কিছু হচ্ছে না! খুন তো করেই যাচ্ছে ইচ্ছেমতো। টিকিটাও ছোঁয়া যাচ্ছে না খুনির। লালবাজারের সঙ্গে নাকি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা করা হয়। এই তো নমুনা!
—তা যা বলেছিস! এদের একজন ফেলুদা বা ব্যোমকেশ দরকার, বুঝলি? না হলে কিস্যু হওয়ার নয়।
ছিছিক্কার চলছিল খবরের কাগজেও দিনের পর দিন। ‘ছ’টি খুনের পরও অন্ধকারে পুলিশ’, ‘লালবাজারের জবাবদিহি চাইল মহাকরণ’, ‘স্টোনম্যানকে ধরতে ল্যাজেগোবরে কলকাতা পুলিশ’… এই জাতীয় হেডিংসংবলিত খবর তখন নিত্যনৈমিত্তিক।
পড়তে-শুনতে খারাপ লাগলেও স্বীকার্য, সমালোচনা প্রাপ্যই ছিল। একটা লোক একই কায়দায় রাতের শহরে খুন করে যাচ্ছে একের পর এক, আর কিস্যু করতে পারছে না কলকাতা পুলিশ, জটিল থেকে জটিলতর মামলার সফল কিনারার জন্য যাদের দেশজোড়া নাম, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’ অভিধাপ্রাপ্তি?
অথচ চেষ্টায় তিলমাত্র খামতি ছিল না লালবাজারের। রাতের শহরে একাকী পথচারী দেখলেই পথ আটকে জেরা করছিল পুলিশ। উত্তরে সামান্যতম অসংগতি পেলেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল লালবাজারে, চলছিল জিজ্ঞাসাবাদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জনাপঞ্চাশ ভবঘুরে প্রকৃতির লোককে আটক করেও তবু সূত্র থাকছিল নাগালের বাইরে। তদন্ত যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আটকে থাকছিল স্থাণুবৎ। পুলিশে ক্রমশ ভরসা হারাচ্ছিল রাতের কলকাতা।
এবং ভরসাহীনতার মরিয়া প্রতিফলন ঘটছিল, দিন যাচ্ছিল যত। পুলিশ যখন পারছে না, নিজেদের সুরক্ষা-বলয় ফুটপাথবাসীরা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছিলেন যথাসাধ্য। পালা করে চলছিল রাত জাগা। একদল ঘুমোচ্ছিলেন রাত দশটা থেকে দুটো। তখন বাকিরা তাস খেলছিলেন। দুটো থেকে অন্যদের জাগার পালা, বাকিদের ঘুমের। ভবঘুরে জাতীয় কাউকে দেখলেই রে রে করে তেড়ে যাচ্ছিলেন ওঁরা। চলছিল দেদার চড়থাপ্পড়, ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রেখে প্রশ্নবাণ এবং কিলঘুসি।
—বল, এত রাতে এখানে কেন?
—বলবে আবার কী, নির্ঘাত এই শালাই স্টোনম্যান! মার ব্যাটাকে!
—হ্যাঁ, মেরে তক্তা করে দি চল…
—কিন্তু পাথরটা কোথায়? বল বল… পাথরটা কোথায় রেখেছিস? না বললে তোর মাথাতেই আজ পাথর ভাঙব।
কত পথচারীকে যে সে-সময় গণপিটুনির হাত থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ, হিসেব নেই। মেরে মুখচোখ ফাটিয়ে দিয়েছে উন্মত্ত জনতা, ‘বিশ্বাস করুন, আমি স্টোনম্যান নই’-এর আকুল আর্তি উপেক্ষা করেই। খবর পেয়ে পুলিশি হস্তক্ষেপে প্রাণে বেঁচেছেন একাধিক নিরপরাধ মানুষ। আর ক্ষোভে-বিদ্রুপে-সমালোচনায় জেরবার পুলিশ ভেবেছে প্রতিটি মুহূর্তে, এর শেষ কোথায়? কী আছে শেষে?
‘শেষ কোথায়’-এর ভাবনার মাঝেই সপ্তম ঘটনা। অকুস্থল, ফের মুচিপাড়া থানা এলাকা। এবার বৈঠকখানা রোড। শিকার এবার তেগা রাই নামের এক অনূর্ধ্ব তিরিশ যুবক। বাড়ি বাড়ি দুধ সরবরাহ করার কাজ করতেন। রাত কাটাতেন ফুটপাথে। রক্তাক্ত অবস্থায় অচৈতন্য পড়ে থাকা তেগাকে যখন পাওয়া গেল রাত তিনটে-সোয়া তিনটে নাগাদ, তখনও প্রাণ আছে দেহে। পাথরের আঘাতে মাথার বাঁ দিক ভেসে যাচ্ছে রক্তে। চুঁইয়ে পড়ে লাল হয়ে গেছে ফতুয়া। তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হল মেডিক্যাল কলেজে। জ্ঞান তো হারিয়েইছিলেন, প্রাণ হারাতে লাগল আটচল্লিশ ঘণ্টা। সাত নম্বর খুন।
প্রথমটা ৪ জুন। জোড়া খুন ১৯ জুলাই। তারপর ২৭ অগস্ট, ৬ সেপ্টেম্বর, ৮ সেপ্টেম্বর, ১১ সেপ্টেম্বর। একশো দিনের মধ্যে একই ‘মোডাস অপারেন্ডি’-তে সাত-সাতটা খুন। হয়নি, কখনও এমনটা হয়নি কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে। এতগুলো খুনের পরও ‘লিড’ পেতে ব্যর্থ হয়েছে লালবাজার, এমনটা ঘটেনি কখনও। প্রশ্ন উঠল বিধানসভায়, লোকসভাতেও আলোচিত হল কলকাতা পুলিশের ব্যর্থতা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিল স্টোনম্যান। বিলেতের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাতে সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ প্রকাশিত হল কলকাতার মধ্যরাতের সিরিয়াল-কিলারকে নিয়ে।
.
সিরিয়াল-কিলিং। ঠিক কী উপাদানে তৈরি হয় একজন সিরিয়াল-কিলারের অন্তরমহল, সে নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিবিধ গবেষণা হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। কোন ব্যক্তিবিশেষের সিরিয়াল-কিলার হয়ে ওঠার নেপথ্যে কয়েকটি কারণকে সচরাচর নির্দিষ্ট করে থাকেন অপরাধ-বিজ্ঞানীরা।
এক, সম-অনুভূতির অভাব। সহানুভূতির অভাব নয়, অভাব সম-অনুভূতির, পরিভাষায় যাকে আমরা বলি ‘empathy’। মনোজগতে ‘empathy’-র অস্বাভাবিক রকমের অভাব একটা পর্যায়ের পর একজন মানুষকে ‘psychopath’ বা মনোবিকারগ্রস্ত করে তোলে। যে বিকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কার্যকারণহীন নির্বিচার হত্যায়।
দুই, নিজের প্রতি বহির্বিশ্বের কৌতূহল উৎপন্ন করার উদগ্র বাসনা, পরিভাষায় ‘attention-seeking’।এবং নিজেকে যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতাবান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার মরিয়া প্রবণতা। পরিণতি, জন্ম নেয় বিকার। যে বিকারের উৎস সিংহভাগ ক্ষেত্রে নিহিত থাকে সমস্যাক্লিষ্ট শৈশবে-কৈশোরে। গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে, সিরিয়াল কিলারদের অনেকেই নানান যন্ত্রণার শিকার হয়েছে ছোটবেলায়। সে মানসিক হোক বা শারীরিক। কেউ হয়তো ছোট থেকেই সাক্ষী থেকেছে মা-বাবার অশান্ত দাম্পত্যের, সাক্ষী থেকেছে বিচ্ছেদের। কেউ হয়তো প্রাপ্য স্নেহ-ভালবাসাটুকু পায়নি অভিভাবকদের কাছে। কেউ হয়তো আবার শিকার হয়েছে পরিচিত কারও যৌন নির্যাতনের।