লালবাজারে বৈঠক হল ফের। কিন্তু প্রয়োজন হল না মিটিং-শেষে কর্তাদের একান্ত আলাপচারিতার। সত্যিটা তখন পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টার মতো বাজতে শুরু করেছে কলকাতা পুলিশের ‘ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে’।
সিরিয়াল কিলিং! সিরিয়াল কিলার!
.
স্ট্র্যাটেজি তৈরি হল নতুন করে। ‘নতুন’ বলতে ‘প্রিভেনশন মেকানিজ়ম’-কে ঢেলে সাজানো। হাজার চেষ্টাতেও যখন ‘ডিটেকশন’ এখনও দূর অস্ত, উপায় কি আর? নৈশ প্রহরার জাল আরও বিস্তৃত করা ছাড়া আর কী-ই বা এই পরিস্থিতিতে করণীয়?
‘করণীয়’-র তালিকার সংক্ষিপ্তসার?
এক, শহরের বিভিন্ন থানার অফিসারদের এবং ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট-এর গোয়েন্দাদের যার যেখানে যা সোর্স আছে, সবাইকে পত্রপাঠ মাঠে নামতে হবে। ‘ডিটেকশন’-এর জন্য শহরজুড়ে সোর্স লাগানো হয়েছিল আগেই, লাভ হয়নি। এবার কাজে লাগাতে হবে, ‘প্রিভেনশন’-এর জন্যও। সোর্সদের উপর নির্দেশ থাকবে রাত দশটা থেকে ভোর ছ’টা অবধি রাতপাহারার। এলাকা ভাগ করে দেওয়া হবে প্রত্যেককে। হাতে দিয়ে দেওয়া হবে নির্দিষ্ট এলাকার ম্যাপ। ‘নির্দিষ্ট এলাকার ম্যাপ’ মানে শহরের যে যে জায়গায় ফুটপাথবাসীদের সম্মিলিত রাত্রিবাস, সেই জায়গাগুলোর হাতে আঁকা ভূগোল। রাস্তায় কাউকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে সোর্স খবর দেবে পুলিশকে। নজরদারিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে মধ্য কলকাতা, যা এখনও পর্যন্ত স্টোনম্যানের বিচরণভূমি।
দুই, সোর্স তো নজরদারির সহায়ক-শক্তি মাত্র, আসল কাজটা তো পুলিশকেই করতে হবে। কী ভাবে? ত্রিমুখী রাতপাহারা, সিদ্ধান্ত নিল লালবাজার। গাড়িতে, পায়ে হেঁটে এবং সাইকেলে। শহরের সমস্ত ওসি এবং এসিপি-দের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল এলাকা। তৈরি হল এলাকাভিত্তিক ‘পেট্রোলিং চার্ট’। ফোকাস, ফুটপাথ। কিন্তু কোন ফুটপাথ? ফুটপাথ তো অসংখ্য। ‘যত মত তত পথ’, আর ‘যত পথ তত ফুটপাথ’, শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। স্টেশন চত্বর, বাস টার্মিনাস, হাসপাতালের বাইরের রাস্তা, এমন কিছু জায়গায় তবু একত্রে রাত্রিবাস করেন ফুটপাথবাসীরা। কিন্তু তার বাইরেও পড়ে থাকে হাজার হাজার অলিগলি, পড়ে থাকে অগুনতি আনাচকানাচ। সর্বত্র সম্ভব নজরদারি? অসম্ভবকে যতটা সম্ভব করা যায়, ঝাঁপাল কলকাতা পুলিশ। হেঁটে, গাড়িতে, সাইকেলে।
তিন, জিআরপি-র ( গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ) সঙ্গে সমন্বয়ে হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে-ভিতরে নৈশপ্রহরায় সামান্যতম ঢিলে দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে শিয়ালদায়। এমন হতেই পারে, ঘাতক আসছে শহরের বাইরে থেকে রেলপথে। কাজ হাসিল করে চম্পট দিচ্ছে রেলপথেই, ভোরের ট্রেনে। কাকভোরের ট্রেনগুলোর যাত্রীদের উপর নজরদারির তীব্রতা থাকতে হবে বিরামহীন।
চার, নজরদারির উপর নজরদারি। প্ল্যানমাফিক প্রহরা চলছে কিনা, তার সরেজমিন তদারকির দায়িত্বে প্রতি রাতে রাস্তায় থাকবেন একজন ডিসি পদমর্যাদার অফিসার। এবং নৈশ অভিযানের খুঁটিনাটি সমন্বয়ের ভার সামলাবেন আরেকজন ডিসি, লালবাজারের কন্ট্রোল রুম থেকে।
কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা আর হল কই? মুচিপাড়া এলাকায় চতুর্থ খুনটা হয়েছিল ২৭ অগস্ট। তার ঠিক দশদিনের মাথায়, ৬ সেপ্টেম্বর, ফের লালবাজারের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিল স্টোনম্যান। হাওড়া ব্রিজে ওঠার মুখে উত্তরদিকের ফুটপাথে অজ্ঞাতপরিচয় বছর পঁয়ত্রিশের যুবক খুন। চেহারা ভবঘুরে প্রকৃতির, মাথায় বাঁ দিকটা থেঁতলানো প্রায় কুড়ি কেজি ওজনের পাথরের আঘাতে। যে পাথরটা, অন্য খুনগুলোর মতোই, পড়ে মৃতদেহের পাশে। দেহ আবিষ্কৃত হল ভোরের দিকে। ময়নাতদন্ত জানাল, হত্যার সময় রাত তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে।
পঞ্চম খুনের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই খুন নম্বর ছয় আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে। ৮ সেপ্টেম্বর। ঘটনাস্থল এবার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে, লালবাজার থেকে বড়জোর সাত-আটশো মিটার দূরত্বে। নিহত দৃশ্যতই ভিক্ষে করে জীবিকানির্বাহ করতেন। বয়স তিরিশের কোঠায়। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজনই, তবু লিপিবদ্ধ থাক তথ্যের স্বার্থে, খুন একই কায়দায়, খুনির হাতিয়ারও একই। পাথর।
শহর জুড়ে ততদিনে ত্রাসের নাম স্টোনম্যান। আতঙ্কের ঠিকানা ফুটপাথ। খবরের কাগজ না হয় ছেড়েই দিলাম, পথেঘাটে-বাসে-ট্রামে-পাড়ার রকের সান্ধ্য আড্ডায় চর্চার বিষয় একটাই। স্টোনম্যান। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আমবাঙালির কথাচালাচালি।যাতে উদ্বেগ যত না,স্বীকার করা ভাল, তার চেয়েও বেশি ধরা পড়ছে রহস্যযাপন, ধরা পড়ছে কিছুটা ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ মার্কা মধ্যবিত্ত স্বস্তিও।
—মারছে তো ফুটপাথে শুয়ে থাকা লোককে। মোদ্দা কথা, মাথার উপর ছাদ আছে যাদের, তারা সেফ। তোর-আমার রিস্ক নেই।
—সেলফিশ মিডলক্লাস মাইন্ডসেট একেই বলে! ফুটপাথের লোকগুলো মানুষ নয়? ওদের জীবনের দাম নেই কোনও?
—তা তো বলিনি। স্টোনম্যানের টার্গেট গ্ৰুপ যে ফুটপাথে রাত কাটানো লোকজন, এতে তো কোনও ডাউট নেই আর। আমি শুধু ভাবছি, একটা লোক খুনের পর খুন করে যাবে এভাবে, আর পুলিশ আঙুল চুষবে, অপেক্ষা করবে পরের খুনটার জন্য?
—কাগজে তো পড়লাম স্পেশ্যাল নাইট পেট্রোলিং শুরু হয়েছে…