মানে? আবার পাথর? দুটো খুনই পাথর দিয়ে মাথায় মেরে? দুটোই ফুটপাথে? আলেয়া বিবির খুনের মোডাস অপারেন্ডির সঙ্গে হুবহু মিল? তা হলে কি ..? কী-কেন তো পরে, ঘটনার ঘনঘটায় গোয়েন্দারা দিব্যি বুঝতে পারছিলেন নির্যাস— ‘নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে!’
আধঘণ্টার মধ্যে ফের বার্তাবাহকের ভূমিকায় কন্ট্রোল রুম, ‘সিপি ডিজ়ায়ার্স টু মিট ডিসি ডিডি অ্যান্ড অফিসার্স অফ দ্য হোমিসাইড স্কোয়াড অ্যাট টেন ইন দ্য লালবাজার কনফারেন্স রুম। ডিসি সেন্ট্রাল শ্যাল অলসো রিমেইন প্রেজ়েন্ট উইথ দ্য ওসি-জ় অফ তালতলা, মুচিপাড়া অ্যান্ড হেয়ার স্ট্রিট পুলিশ স্টেশনস।’
.
ঘণ্টাখানেকের বৈঠকে তিনটে খুন নিয়েই কাটাছেঁড়া করলেন নগরপাল। অফিসারদের প্রত্যেকের মতামত জানতে চাইলেন। শুনলেন ধৈর্য ধরে। অল্পসময়ের ব্যবধানে একই ধাঁচের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে যা আশু জরুরি হয়ে ওঠে, আলোচনা হল তা নিয়েই।
এক, ‘ডিটেকশন’। ঘটে যাওয়া খুনগুলোর কিনারা করা যত দ্রুত সম্ভব। দুই, ‘প্রিভেনশন’। যতক্ষণ না সমাধানসূত্র পাওয়া যাচ্ছে, একই ধরনের খুন আর ঘটতে না দেওয়া।
সিপি এবং ডিসি ডিডি তো বটেই, অন্য অফিসাররাও টের পাচ্ছিলেন, আলোচনা করা এক, আর তার সফল প্রয়োগ আরেক। ‘ডিটেকশন’-এর দিক থেকে ভাবলে, আলেয়া বিবির খুনে আপ্রাণ চেষ্টা করেও সামান্যতম ‘লিড’ও অধরা এখনও। তার মধ্যেই এই জোড়া খুন।
নিহত তিন। একজন মহিলা, পুরুষ একজন, তৃতীয়জন নেহাতই কিশোর। মহিলার পরিচয় জানা গেছে। বাকি দু’জনের এখনও নয়। হয়তো জানা যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। কিন্তু পরিচয় সে যা-ই হোক, তিনটে খুনেই কমন ফ্যাক্টরগুলো তীব্র অস্বস্তি উৎপন্ন করছে। খুনির হাতিয়ার তিনটে ক্ষেত্রেই পাথর। তিনটে ঘটনারই সময়কাল শেষ রাত থেকে ভোরের মধ্যবর্তী। এবং ‘ভিক্টিম প্রোফাইল’ তিনটে ক্ষেত্রেই সমগোত্রীয়। আততায়ী বেছে নিয়েছে নিরাশ্রয় ফুটপাথবাসী কাউকে। যাদের খুন করে অর্থাগমের সম্ভাবনা নেই কোনও।
পদ্ধতি এক। টার্গেট-চরিত্র এক। আঘাত হানার সময়টাও এক। ‘ক্রাইম প্যাটার্ন’-এ এত যখন মিল, আততায়ীও এক? যদি আশঙ্কাই সত্যি হয়, যদি একই লোক হয়, তা হলেও নাগাল পাওয়ার মতো সূত্র কই? পার্ক স্ট্রিট মেট্রোর কাছে খুন হওয়া মাঝবয়সি এবং শিয়ালদায় নিহত কিশোরের পরিচয় জানতে পারলে দিশা মিলবে কিছু? যোগসূত্র কোনও?
এ তো গেল ‘ডিটেকশন’-এর সাতসতেরো। কিন্তু ‘প্রিভেনশন’? কী করে হবে ‘প্রিভেনশন’? অত সোজা? এ শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, হাজার হাজার মানুষ ফুটপাথে রাত্রিযাপন করেন এখানে-ওখানে-সেখানে। সম্ভব পাহারা দেওয়া?
সংকট যখন চোখ রাঙায়, সম্ভব-অসম্ভব নিয়ে মাথা ঘামানোর অত সময় থাকে না। অগ্রাধিকার পায় যে ভাবেই হোক মুশকিল আসানের রাস্তা খোঁজা। সিদ্ধান্ত হল, নৈশ নজরদারি বাড়ানো হবে শহরে। তিনটে খুনই হয়েছে সেন্ট্রাল ডিভিশনে, মধ্য কলকাতায়। ঠিক হল, মধ্য কলকাতার সব ওসি নিয়ম করে থাকবেন রাতপাহারায়, চলবে টহলদারি। শুধু গাড়িতে নয়, পায়ে হেঁটেও চালু হবে নৈশ-নজরদারি। শহরের বাকি এলাকার ডিসি-ওসি-দেরও শোনানো হল সতর্কবার্তা, বলা হল রাতের শহরে পুলিশি উপস্থিতি বাড়াতে।
মিটিংয়ের শেষে গোয়েন্দাপ্রধান অর্থাৎ ডিসি ডিডি-কে ঘরে ডেকে নিলেন নগরপাল। কথাচালাচালি হল খানিক।
—কী বুঝছ… খোলাখুলি বলো…
ডিসি ডিডি কয়েক সেকেন্ড ভাবার পর উত্তর দিলেন।
—লুকস কোয়াইট স্ট্রেঞ্জ স্যার … কোনও কানেক্ট এখনও পাওয়া যাচ্ছে না.. অথচ তিনটে খুনই একই ভাবে … সিমিলারিটিটা …
মাঝপথে থামিয়ে দেন নগরপাল।
—সেজন্যই তো বললাম খোলাখুলি বলতে। কী মনে হচ্ছে… সিরিয়াল কিলিং?
উত্তর দেন না গোয়েন্দাপ্রধান। স্রেফ তাকান সিপি-র দিকে। নগরপালও নিরুত্তরই থাকেন।
আশঙ্কা আর উদ্বেগ কবেই বা আর শব্দের তোয়াক্কা করেছে?
.
আশঙ্কা সত্যি হল আপাদমস্তক, উদ্বেগ ঊর্ধ্বগামী হল মাসখানেকের মধ্যেই। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খুনে নিহতদের পরিচয় মেলেনি তখনও, অফিসারদের জানকবুল চেষ্টা সত্ত্বেও। চলছে নৈশপ্রহরা পরিকল্পনামাফিক। তবু ২৭ অগস্ট ফের খুন, ফের ফুটপাথ, ফের পাথর! শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে নেমে সাবওয়ের পথে এবার, টার্গেট এবারও রাস্তায় ঘুমন্ত, হা-ক্লান্ত, আশ্রয়হীন। মধ্যতিরিশের ভবঘুরে ভিক্ষুক। হননকাল, ভোর চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে।
যে সময়ের কথা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দাপট তখনও মাথাচাড়া দেয়নি। একচেটিয়া আধিপত্য ছাপার অক্ষরের। লেখালেখি হচ্ছিল বটে তিনটে একই ধাঁচের খুন নিয়ে, কিন্তু উদ্বাহু হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপকরণ ছিল না পর্যাপ্ত। যে সমস্যা রইল না একই কায়দায় চতুর্থ খুনের পর। খবরের কাগজ যা যা ছিল শহরে, একযোগে মাঠে নামল। শিরোনামে চলে এল পুলিশি ব্যর্থতা, ফ্রন্ট পেজ দখল করল রাতের শহরের রহস্যময় ঘাতক। একটি জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক লিখলেন, ‘Stoneman Strikes Again!’
সেই প্রথম ব্যবহৃত হল ‘স্টোনম্যান’ শব্দটা। যা সমার্থক হয়ে গেল মামলার সঙ্গে, এবং তার চেয়েও ঢের জরুরি, আতঙ্কের আহ্বায়ক হিসাবে দেখা দিল শহর কলকাতার মননে-মানসে।