ধৈর্য বিপদসীমা অতিক্রম করে ওসি হোমিসাইডের। হাড়মাস কালি হয়ে গেছে এই লোকটার জন্য। চাকরিটাই যেতে বসেছিল প্রায়। আর ধরা পড়ার পর টাইমমেশিনে নেতাজির আমলে ফিরে যাওয়ার অভিনয় করে চলেছে আধঘণ্টা ধরে। এখনই একটি প্রবল চপেটাঘাত প্রয়োজন। এমন একটি বিরাশি সিক্কা, যা দ্রুত বর্তমানে ফিরিয়ে আনবে শ্ৰীমানকে।
থাপ্পড়টা অসমাপ্তই থেকে যায় গোয়েন্দাপ্রধানের হন্তদন্ত আবির্ভাবে। যিনি খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন পড়িমরি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ওসি, ‘আসুন স্যার.. বসুন..।’
বসেন না গোয়েন্দাপ্রধান। একদৃষ্টে স্থির তাকিয়ে থাকেন চেয়ারে বসা স্মিতহাস্য লোকটির দিকে। এই লোকটা? এ-ই স্টোনম্যান? যে শুধু লালবাজার নয়, পুরো শহরের ঘুম কেড়ে নিয়েছে গত ন’মাস ধরে? শান্তভাবে প্রশ্ন করেন মাঝবয়সিকে, ‘কী নাম আপনার?’
.
ফিরে দেখা সেই মামলাকে, প্রায় তিন দশক পেরিয়েও যা নিয়ে আমজনতার ঔৎসুক্যের পারদ কণামাত্র নিম্নগামী হয়নি, কৌতূহলের তীব্রতার নিরিখে যা কলকাতা পুলিশের শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসে আজও তর্কাতীত শীর্ষবাছাই।
১৯৮৯-এর চৌঠা জুনের সাতসকাল। হেয়ার স্ট্রিট থানার ডিউটি অফিসার ফোনটা ধরলেন, শুনলেন এবং বুঝলেন, দিনটা খারাপ ভাবে শুরু হতে যাচ্ছে। খুন হয়ে গেছে একটা। কোথায়? লালবাজারের নাকের ডগায়।
‘নাকের ডগা’ বলতে বিবাদী বাগের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনা। মধ্যতিরিশের মহিলা পড়ে আছেন প্রাণহীন। গভীর ক্ষতচিহ্ন মৃতার মাথার ডান দিকে। মাথার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা বড় পাথর। যাতে রক্তের লাল-কালচে ছিটে জানান দিচ্ছে, খুনির হাতিয়ার ছিল ওই পাথরটাই। যার ওজন প্রায় সাড়ে নয় কেজির মতো। ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়াই বোঝা যাচ্ছিল সাদা চোখে, একেবারে কাছ থেকে খুনি পাথরটা আছড়ে ফেলেছে মহিলার মাথায়। অত ভারী পাথর মাথায় সজোরে আঘাত করলে যা হয়, ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু এসেছে অনিবার্য। ডাক্তারি পরিভাষায়, ‘Death was due to the effects of injuries, ante-mortem and homicidal in nature.’
মৃতার পরিচয়? আলেয়া বিবি, ফুটপাথবাসিনী। স্থায়ী আস্তানা বলতে কিছু ছিল না। স্বামী মোহন সাউয়ের খুচরো বিক্রিবাটার কাজে টুকটাক সাহায্য করতেন। রাস্তাতেই দম্পতির দিন গুজরান, রাস্তাতেই নিশিযাপন। রাত এগারোটা নাগাদ ঘুমিয়েছিলেন রোজকার মতো। ভোরে আবিষ্কৃত হল মৃতদেহ। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানাল, খুনটা হয়েছে রাত চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। শরীরের অন্য কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, চিহ্ন নেই কোনওরকম বলপ্রয়োগের। মৃতা তিন মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন।
কে খুনটা করল-র থেকেও ‘কেন করল’-টাই ধন্দে ফেলল হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দাদের। মোহন সাউ স্ত্রী আলেয়াকে নিয়ে বিহারের দ্বারভাঙা থেকে জীবিকার খোঁজে কলকাতায় এসেছিলেন কয়েক বছর আগে। দিন আনি দিন খাই-এর চালচুলোহীন সংসার। ঠিকানা ফুটপাথ। আলেয়াকে খুন করে অর্থলাভের সম্ভাবনা শূন্য। মোটিভ হিসাবে অন্য যে সম্ভাবনাটা মাথায় আসবেই, যৌন-ঈর্ষা? স্বামী-স্ত্রী-র সম্পর্কে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবজনিত টানাপোড়েন? খোঁজখবর নেওয়া হল যতটা তলিয়ে সম্ভব, কিন্তু মোহন-আলেয়ার সম্পর্কে ন্যূনতম অশান্তি-অস্থিরতার আঁচ পাওয়া গেল না। তা হলে?
‘তা হলে?’-র উত্তর অমিলই থাকল প্রায় মাসদেড়েক। তার পরেও যে ধাঁধার জবাব পাওয়া গেল, এমন নয়। বরং ঘটল উলটোটা। ১৯ জুলাইয়ের রাত রাতারাতি অন্য মাত্রা দিল পঁয়তাল্লিশ দিন আগের আলেয়া-হত্যাকে, যাকে স্রেফ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করার বিলাসিতা আর রইল না লালবাজারের। থাকবেই বা কী করে? এবার তো জোড়া খুন!
প্রথমটা তালতলা থানা এলাকায়। জিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র উত্তরমুখী গেটের অদূরে, পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে ঢোকার সিঁড়ির মুখে। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছরের নিথর রক্তাক্ত দেহটা ছ’টা-সোয়া ছ’টা নাগাদ নজরে আসে পথচারীদের। ছেঁড়াখোঁড়া জামাপ্যান্ট, শীর্ণ চেহারায় অপুষ্টির ছাপ প্রকট। মাথার ডান দিকটা তীব্র আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে প্রায়। যা দিয়ে আঘাত, সেটা পড়ে আছে মাথার পাশে। পাথর, প্রমাণ সাইজ়ের। ওজন? তা কুড়ি কেজি তো হবেই।
গোয়েন্দারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছে ছবি তুলছেন নিহতের, ওসি হোমিসাইড যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দ্রুত ফরেনসিক পরীক্ষার আয়োজনে, কন্ট্রোল রুম মারফত ওয়ারলেস বার্তা এল, ‘সাসপেকটেড মার্ডার ইন মুচিপাড়া পিএস এরিয়া… নিয়ার শিয়ালদা স্টেশন সাবওয়ে… ভিকটিম আ টিনএজার ..।’
গোয়েন্দাপ্রধান কিংবা নগরপাল স্বয়ং, সকাল-সকাল জোড়া খুনের খবরে বিচলিত হননি কেউই। গড়পড়তা পুলিশি রোজনামচার মাঝে হয় কখনও কখনও এমন। আসে, এমন এক-একটা দিন আসে, কোনও এক অদৃশ্য ষড়যন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে যাবতীয় খারাপ যেন একসঙ্গে ঘটতে থাকে।
বিচলিত হওয়ার কারণ ঘটল ওসি মুচিপাড়ার বার্তায়, ‘স্যার.. বাচ্চা ছেলে … বয়স এই চোদ্দো-পনেরো হবে .. আইডেন্টিটি এস্ট্যাব্লিশড হয়নি এখনও… যেটুক পাচ্ছি, স্টেশনের ফুটপাথে থাকত .. ভিক্ষে করত … হেড ইনজুরি মাথার বাঁ দিকে.. একটা বড় পাথর দিয়ে মাথায় মারা হয়েছে .. পাথরটায় ব্লাড স্টেইনস আছে…।’