.
অঙ্কুশ-মণিময়-লিন্ডা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। পুরো ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন বিচারকের সামনে। জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্রেফ বোড়ে ছিলেন, জানতেন না কিস্তিমাতের আসল ছক। লিন্ডা অকপটে বলেছিলেন আদালতে, জেমসের সঙ্গে আলাপ মধ্য কলকাতার এক চার্চে। জড়িয়ে পড়েছিলেন গভীর সম্পর্কে। যা বলতেন জেমস, অন্ধের মতো মেনে চলতেন।
জেমসের থেকে পাওয়া গেল আমেরিকা-প্রবাসী দুই নাইজেরীয় বন্ধুর খুঁটিনাটি। যারা সরবরাহ করত কার্ডের তথ্য। এবং জেমস ভারতে বসে লোপাট করে দিত লক্ষ লক্ষ টাকা। ভাগবাঁটোয়ারা হত অনলাইনে। FBI (ফেডারাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন)-এ বিস্তারিত জানিয়ে মেল করে দেওয়া হল লালবাজারের তরফে।
তিন বছর লেগেছিল বিচারপর্ব শেষ হতে। রাজসাক্ষী লিন্ডা-অঙ্কুশ-মণিময়কে সাজা দেননি আদালত। দশ বছরের কারাদণ্ড বরাদ্দ হয়েছিল তিন চক্রীর জন্য। বেনসন-জেমস-পিটার।
শাস্তি যেদিন ঘোষণা হয়েছিল, আদালত থেকে বেরনো মাত্রই ফোনে মেসেজ এসেছিল সৌম্যর। ডিসি ডিডি লিখেছিলেন, ‘Well done. The reward of a good job done is to have done it.’
সেই মেসেজ আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সৌম্য। ভাল কাজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার কী হতে পারে? ভাল কাজটাই তো!
পুনশ্চ: লিন্ডা, অঙ্কুশ এবং মণিময়, তিনটি নাম পরিবর্তিত ওঁদের সামাজিক বিড়ম্বনা এড়াতে।
২.১১ দ্য পারফেক্ট ক্রাইম
[স্টোনম্যান
বারোটি মামলায় একাধিক তদন্তকারী অফিসার ছিলেন।]
ক্রিং ক্রিং…
কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে যা হয়, মেজাজটা খিঁচড়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধানের। অনেক রাত অবধি একটা কেস ডায়েরি দেখেছেন। ডাকাতির মামলা। ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ধরা পড়ে গিয়েছিল ডাকাতরা। তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে আড়াই মাসের মধ্যেই তদন্তকারী অফিসার চার্জশিট তৈরি করে ফেলেছেন বিস্তর খেটেখুটে। কাল-পরশুর মধ্যেই জমা পড়বে আদালতে। কোথাও কোনও ফাঁকফোকর যাতে না থাকে, একবার তাই খুঁটিয়ে দেখতেই হত। ফাইলটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। ডিনারের পরে বসেছিলেন কেসটা নিয়ে। চার্জশিটের খুচরো ভুলগুলো লাল পেনে মার্ক করে যখন শুতে গিয়েছিলেন, ঘড়ির কাঁটা দুটো ছাড়িয়েছে। জমাট ঘুমের মধ্যপথে ছন্দপতন পৌনে পাঁচটা নাগাদ ..ক্রিং ক্রিং..।
কথায় বলে, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, সে ভাল হোক বা মন্দ। ভোরের স্বপ্নের সত্যি-মিথ্যে জানা নেই। তবে পুলিশের চাকরিতে কাকভোরের ফোন অশনিসংকেতই বয়ে আনে সচরাচর। দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর কেউ ভোরে সিনিয়র অফিসারের ঘুম ভাঙাতে বাধ্য হচ্ছে মানে, অবধারিত কোথাও ডাকাতি, নয়তো খুন। কিংবা দাঙ্গা, বা আরও খারাপ কিছু। ঘুমচোখেই বেডসাইড টেবলে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললেন গোয়েন্দাপ্রধান। অন্য প্রান্ত থেকে যে উদ্বিগ্ন আওয়াজটা ভেসে এল, সেটা দীর্ঘদিনের পরিচিত। ওসি হোমিসাইড।
—নমস্কার স্যার, আবার!
আবার! শুনেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসেন গোয়েন্দাপ্রধান।
—মানে?
—আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজের কাছে স্যার.. সিইএসসি-র ট্রান্সফর্মার আছে একটা …
—কখন হল?
—খবরটা থানায় এসেছে মিনিট দশেক হল, আমি থানার ফোনটা পেয়েই…
—তুমি শিয়োর? আই মিন মোডাস অপারেন্ডি…
—হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্যার.. যা শুনলাম .. জাস্ট দ্য সেম..
—হুঁ .. তোমরা বেরও.. পৌঁছও অ্যাজ় আর্লি অ্যাজ় পসিবল..আসছি।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পর মিনিটখানেক থম মেরে বসে থাকেন গোয়েন্দাপ্রধান। আবার? তা হলে যে অস্বস্তিটা কাঁটা হয়ে বিঁধছিল মাসখানেক ধরে, সেটাই সত্যি হল? ইংরেজিতে বলে না.. ‘worst fears coming true?’
সিপি-কে এখনই জানানো দরকার। বেরনোর জন্য তৈরি হতে হতেই ফোনে ধরলেন। সিপি শুনলেন এবং একটিই শব্দ খরচ করলেন, ওসি হোমিসাইডের একটু আগের ফোনে ‘নমস্কার স্যার’-এর পর যে শব্দটা ছিটকে এসেছিল।
—আবার!
গোয়েন্দাপ্রধানের গাড়ি যখন মৌলালির কাছাকাছি, আলো আলতো আঁচড় কাটতে শুরু করেছে আকাশে। রাত তখন ভোরপ্রবণ।
.
—স্যার, সুভাষবাবুর পরের সভাটা কখন কোথায়, বলবেন প্লিজ়?
সুদূরতম কল্পনাতেও উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকা মাঝবয়সি লোকটির থেকে এ প্রশ্ন আশা করেননি ওসি হোমিসাইড। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন যুবকের মুখের দিকে। ভুল শুনলেন না তো? জিজ্ঞেস করেন ঠান্ডা গলায়, ‘কার সভা?’
উত্তর আসে নির্বিকার।
—সুভাষবাবুর স্যার, নেতাজি সুভাষ।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন গোয়েন্দারা। ইয়ার্কি করছে? লালবাজারে এসে মশকরা করবে, তা-ও হাতেনাতে ধরা পড়ার পর? না কি সেয়ানা পাগলের ভেক ধরেছে মার এড়াতে?
এক অফিসার কলার চেপে ধরেন মাঝবয়সির।
—চ্যাংড়ামি হচ্ছে? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাননি? নেতাজি? সোজাসুজি সবটা খুলে বলুন, একটা একটা করে। আদরযত্ন তো এখনও শুরুই করিনি। শুরু করলে একটা মারও বাইরে পড়বে না, গলগল করে বেরিয়ে আসবে সব। যত্নআত্তি করব, না এমনিই বলবেন? ব্যাটা বলে কিনা সুভাষবাবু!
অবাক হয়ে অফিসাররা লক্ষ করেন, কোনও ভাবান্তর নেই লোকটির। শরীরী নড়াচড়ায় না আছে কোনও উদ্বেগের আভাস, না আতঙ্কের। মৃদু হেসে জবাব দেয় পুলিশি হুমকির, ‘হ্যাঁ স্যার, নেতাজি। কী অপূর্ব বললেন আজ! বললেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। পরের সভাটা কোথায় হবে স্যার?’