বেনসনের কাছ থেকেও পাওয়া গেল বেশ কয়েক গোছা জাল কার্ড। এবং তার পাসপোর্টটা ভাল করে দেখার পর বোঝা গেল, ভারতে থাকার ভিসার কাগজটাও জাল।
পিটারের ব্যাগ থেকে একটা ল্যাপটপ পাওয়া গেল। সেটা বাজেয়াপ্ত করার আগে ডেটা কপি করে নেওয়া হল একটা হার্ড ডিস্কে। ডিস্কটার আদ্যোপান্ত ঘেঁটে দেখা গেল, পিটার মার্কিন নাগরিকদের কার্ডের তথ্য পেত একটা মেল আইডি থেকে। man-t-2@yahoo.com। কথাবার্তা হত yahoo messenger-এ।
কে এই man-t-2? পিটার জানাল, man-t-2-র নাম জেমস। নাইজেরীয়, ভারতেই থাকে। একসময় আমেরিকাতে ছিল। মার্কিন বন্ধুবান্ধব আছে বেশ কিছু। তা হলে আসল লোক পিটার নয়, জেমস?
Yahoo Messenger-এর লগ ডিটেলস নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে বোঝা গেল, জেমসের বর্তমান অবস্থান পুনেতে। ভোঁসারি থানার অন্তর্গত গণেশওয়াড়ি নামের এক জায়গায়। অতএব চলো পুনে।
.
গণেশওয়াড়ি। মহল্লার আয়তন ছোট নয় খুব একটা। দিনভর এলাকা চষে ফেললেন সৌম্য এবং সহযোগী অফিসাররা। দোকানে-পাড়ায়-রকের আড্ডায় স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে জানার চেষ্টা করলেন, কালো চামড়ার লোক থাকে নাকি আশেপাশে? সন্ধের দিকে এক চায়ের দোকানের মালিকের কাছে হদিশ মিলল।
—আপনারা কি কালো ইংরেজদের কথা জিজ্ঞেস করছেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, গায়ের চামড়া কালো, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলে? জানেন?
—হ্যাঁ, কালো ইংরেজ থাকে একটা বাড়িতে। এই রাস্তাটা ধরে সোজা গিয়ে একটা মোড় পড়বে, সেখান থেকে বাঁ দিকে…
—একটু দেখিয়ে দিন না প্লিজ়… সেই কলকাতা থেকে এসেছি।
দেখিয়ে দিলেন চা-দোকানি। সঙ্গে সঙ্গে সৌম্য যোগাযোগ করলেন ভোঁসারি থানায়। ‘রেইড’ করা হল প্রায় মাঝরাতে। বেল বাজানোর পর দরজা খুললেন স্কার্ট-টপ পরিহিতা এক তরুণী। ভারতীয়। যিনি কিছু বোঝার আগেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল পুলিশ। এবং দু’কামরার ছিমছাম ফ্ল্যাটের শোওয়ার ঘরে আবিষ্কার করল এক নাইজেরীয় তরুণকে। টি-শার্ট আর শর্টস পরে একমনে ঝুঁকে ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
পিঠে হাত পড়তে মুখ তুলে তাকালেন তরুণ। সৌম্য সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘How is life James?’
—I am not James. Myself Christopher.
—And who is she?
—She’s Noa. Lives in Chennai. We are going to be married soon and shall leave for Dubai.
পাসপোর্ট দেখালেন যুবক। নাম সত্যিই ক্রিস্টোফার। নোয়া নামক তরুণীকে বিয়ে করে পাড়ি দেওয়ার কথা দুবাই। ভিসাও হয়ে গেছে। কাগজপত্র দেখা হল। মিথ্যে নয়। পাসপোর্ট-ভিসায় গরমিল নেই কোনও। তা হলে?
‘জেমস’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে নোয়ার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল আচমকা, লক্ষ করেছিলেন এক অফিসার। কেন, সেটা বোঝা গেল বসার ঘরে পড়ে থাকা একটা চামড়ার ব্যাগ তল্লাশি করার পরেই। যাতে পাওয়া গেল বেশ কিছু জামাকাপড় আর কিছু ফটো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক মাঝবয়সি নাইজেরীয়কে। এই ক্রিস্টোফারের সঙ্গে কোনও মিল নেই ছবির।
—ফটোর লোকটা কে? এক মহিলা অফিসারের ধমকে নোয়া ভেঙে পড়লেন।
—জেমস। তোমরা যাকে খুঁজছ। Egbe Dakun James Taino। এই ফ্ল্যাটটা ওর ভাড়া করা। ক্রিস্টোফার ওর বন্ধু। ক্রিস্টোফার আর আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছে জেমস। আজ বিকেলের ফ্লাইটে মুম্বই হয়ে দিল্লি গেছে। তবে কয়েকদিন পরই ফিরবে। আমরা এর বেশি কিছু জানি না স্যার।
শর্ত দিলেন সৌম্য। দুবাইও যাওয়া হবে, আর বিয়েও ভণ্ডুল হয়ে যাবে না, যদি জেমস এই ফ্ল্যাটে ফেরার পর ওঁরা ফোন করে জানিয়ে দেন কলকাতায়। আপাতত ওঁদের পাসপোর্টগুলো জমা রইল পুলিশের কাছে। জেমসের খবর পেলে পুলিশ আবার আসবে। তখনই ফেরত দেওয়া হবে পাসপোর্ট।
প্রস্তাবে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না ওঁদের। সৌম্যরা ফিরে এলেন কলকাতায়। ভোঁসারি থানার অফিসাররা নজরদারির ব্যবস্থা করলেন ফ্ল্যাটে।
বহুপ্রতীক্ষিত ফোন এল দিনদশেক পরে। সাতসকালে সৌম্যর মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘Noa Calling’।
—স্যার, জেমস গত কাল রাতে এসেছে। ঘুমচ্ছে এখন। কাল সকালের ফ্লাইটে আবার মুম্বই চলে যাবে।
মানে দাঁড়াচ্ছে, আজই পৌঁছতে হবে, যে ভাবেই হোক। তদন্তে এমন হয় কখনও কখনও, এক সেকেন্ডও দেরি করা চলে না। যেটা করতে হবে, সেটা তখনই করতে হবে।
করা হল। গোয়েন্দাপ্রধানকে জানানো হল। যাঁর নির্দেশে দুপুরের ফ্লাইটে মুম্বই রওনা দিলেন অফিসারেরা। মুম্বই-পুনে হাইওয়ে ধরে রওনা দিলেন সড়কপথে। যখন গণেশওয়াড়ি পৌঁছনো গেল, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা ছাড়িয়ে ন’টার পথে রওনা দিয়েছে।
মাঝবয়সি নাইজেরীয়, James Taino, Yahoo messenger-এ চ্যাট করছিলেন ফ্ল্যাটে বসে। আইডি? man-t-2।
ল্যাপটপের দু’-একটা ফোল্ডার এলোমেলো চেক করতেই বেরিয়ে পড়ল অজস্র কার্ডের ডিটেলস। Track-1 এবং Track-2, যেগুলো থাকে কার্ডের পিছনের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপের মধ্যে। খালি চোখে যা দেখতে পাওয়ার কথাই নয়। ডেটা বোঝাই হয়ে আছে ল্যাপটপে। যা দিয়ে চলছিল লক্ষ লক্ষ টাকার জালিয়াতি, ‘ইধার কা মাল উধার’।
পরের দিন জেমসকে স্থানীয় কোর্টে হাজির করে ‘Transit Remand’ নিয়ে ফের রওনা দেওয়া। সড়কপথে ফের মুম্বই। সেখান থেকে কলকাতার উড়ান।