‘তখন’ যে পুরো গ্যাংটাই হাতের বাইরে চলে যেতে পারে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না গোয়েন্দাদের। আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হচ্ছিল। এসব মামলায় ‘ডিজিটাল এভিডেন্স’ সংগ্রহ না করতে পারলে চার্জশিটটা দাঁড়াবেই না। আর সাইবার-ফুটপ্রিন্টস মুছে ফেলতে আর কতক্ষণ? সাবধানে পা ফেলা ছাড়া উপায় কী?
স্ট্যানলির খোঁজে ফের যাওয়া হল আইএফএ অফিসে। এই নামে কোনও নাইজেরীয় ফুটবলার আছে? নেই। নাইজেরীয় দূতাবাসে নেওয়া হল খোঁজখবর। এই নামের কেউ ভারতে এসেছেন সম্প্রতি? কোনও রেকর্ড আছে? পাওয়া গেল না। শহরের যেখানে যেখানে নাইজেরীয়দের বেশি দেখা যায়, সোর্স লাগানো হল সেখানে। স্ট্যানলি নামের কারও খোঁজ পেলেই যেন খবর পাওয়া যায়। সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, খবর এল না কিছু।
কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবং ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির আরও টুকটাক অভিযোগ জমা পড়ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। অথচ তদন্তে যা যা করার, সবই তো করা হচ্ছে। মার্চের মাঝামাঝি একদিন কাজ সেরে অফিস থেকে যখন বেরচ্ছেন হতোদ্যম সৌম্য, রাতের লালবাজার শুনশান। বোসপুকুরে নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে গেল সৌম্যর। ড্রয়িংরুমের সেন্টারটেবিলে ‘ফেলুদাসমগ্র’ রাখা। একমাত্র কন্যা ক্লাস সিক্সে পড়ে। গোয়েন্দাগল্পের পোকা। ফেলুদা বলতে অজ্ঞান। অবশ্য কে নয়? সময়-সুযোগ পেলে সৌম্য নিজেই পঞ্চাশবার পড়া ফেলুদা-কাহিনি আবার নিয়ে বসে যান পাতা উলটোতে। বইটায় বুকমার্ক দিয়ে শুতে গেছে মেয়ে। সৌম্য হাতে তুলে নেন। শোবার আগে ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ পড়ছিল। গল্পটার নাম শুনলেই অবধারিত মনে পড়ে যায় কালীকিঙ্করবাবুর সেই টিয়ার কথা, ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’। সিন্দুকের কম্বিনেশন লকের কোড। ফেলুদার মগজাস্ত্র যে কোডের রহস্যভেদ করেছিল, ‘থ্রি নাইন জিরো থ্রি নাইন এইট টু জিরো!’
ঘুম আসতে দেরি হবে আজ। মাথায় ঘুরছে Mr Stanley Rodriges। ফেলুদার বই রেখে দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলেন সৌম্য। মগজাস্ত্রের প্রয়োগ যদি করা যেত ফেলু মিত্তিরের মতো! বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে একসময় উঠে পড়েন। কম্পিউটার খুলে বসেন। শূন্য থেকে শুরু করা যাক। কার্ড স্কিমিং-এর জালিয়াতি বিশ্বের কোথায় কোথায় কীভাবে হয়েছে, কীভাবে সমাধান হয়েছে, লিঙ্কগুলো আবার দেখা যাক। যদি দিশা পাওয়া যায় কিছু।
গুগল নিমেষে লিঙ্ক ভাসিয়ে দিল অসংখ্য। সৌম্য চোখ বোলাচ্ছিলেন। একটার হেডিং, ‘All you need to know about MSR’। এটা আগেও পড়েছিলেন। MSR, অর্থাৎ ‘Magnetic Stripe Readers’। দেখতে থাকেন সাব-হেডিং, “how to keep your card safe from MSR”.. ‘Magnetic Stripe Reader, a device used to read magnetic stripe cards such as credit cards.’
একবার পড়েন, দু’বার পড়েন। বারবার তিনবার পড়েন। তৃতীয় বারের পড়ায় শুধু দুটো শব্দে চোখ চুম্বকের মতো আটকে যায়। ‘Safe’ আর ‘MSR’। কেন চোখ সরছে না? কেন স্নায়ু আচমকাই চঞ্চল হয়ে উঠছে? কেন মস্তিষ্কে উত্তেজক তরঙ্গ টের পাচ্ছেন হঠাৎ?
সংকেত? কোড? ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন’ -এর মতো? M ফর Mr, S ফর Stanley, R ফর Rodrigues? MSR? যাকে ‘safe’ রাখতে সাংকেতিক নির্দেশ পাঠিয়েছে পিটার? হতেই হবে.. এটা কোডই … কোড না হয়ে যায় না… Magnetic Stripe Reader? এ ছাড়া আর কোনও সম্ভাবনা পড়ে থাকে না। সৌম্য বুঝতে পারেন, রাতে ঘুম আসবেই না আর। ফোনে ধরেন ওসি ব্যাংক ফ্রড-কে, ‘স্যার, Mr. Stanley Rodrigues…!’
.
লিন্ডার বাড়িতে এখন ‘রেইড’ করাটা মূর্খামি হবে, সিদ্ধান্ত হল সর্বসম্মত। MSR পাওয়া গেলেও পিটারকে আর পাওয়া যাবে না। দিন পনেরোর মধ্যেই যে কলকাতায় আসবে বলে লিন্ডাকে জানিয়েছে মেলে। ঘটনার বিশ্লেষণ করে যা বোঝা যাচ্ছে, পিটার অন্যতম নাটের গুরু। এখন আছে নাইজেরিয়ায়। লিন্ডার ভাড়ার ফ্ল্যাটটা তার কলকাতার আস্তানা। বেনসন-মণিময়-অঙ্কুশরা, যেমন ভাবা গিয়েছিল, স্রেফ চুনোপুঁটি স্তরের শাগরেদ।
অপেক্ষা করা শুরু হল পিটারের শহরে আসার। বেনসনের খেলাধুলো আর লিন্ডার বাড়ি আসা-যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই চলছে। অঙ্কুশও আর আগের মতো ঘরবন্দি থাকছে না। এবং যেমন ভাবা হয়েছিল, পুলিশি খোঁজখবর একটু থিতিয়ে যেতেই কলকাতায় ফিরে এসেছে মণিময়। মেট্রোপ্লাজার একতলার একটা রেডিমেড কাপড়ের দোকানে বসছে নিয়মিত। এদের ধরা তো জলভাত। ঠিক সময়ে তুলে নেওয়া যাবে।
অবশেষে লিন্ডার ইনবক্সে ঢুকল কাঙ্ক্ষিত বার্তা। ‘Sweetheart, arriving tomorrow…’। লাগোস থেকে দুবাই হয়ে কলকাতায় আসছে পিটার। এমিরেটস-এর ফ্লাইটে।
তিনটে টিম করা হল। একটা যাবে এয়ারপোর্টে, পিটারকে ধরতে। একটা কিড স্ট্রিটের ডেরা থেকে বেনসনকে তুলবে। আর তৃতীয় দলের দায়িত্ব থাকবে অঙ্কুশ-মণিময়কে তুলে আনার।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ শুরুর অনুচ্ছেদে লিখেছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরনোর পর লিন্ডা পিটারকে জড়িয়ে ধরা মাত্র ঘিরে ধরলেন অফিসাররা।
—ইয়োর গেম ইজ় আপ…
—হোয়াট? হোয়াট গেম আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? আই ডোন্ট গেট দিস…
.
স্বীকারোক্তি আদায়ে বিশেষ অসুবিধে হল না। লিন্ডা আর পিটারকে একসঙ্গে বসিয়ে মেল চালাচালির প্রিন্ট আউটগুলো মেলে ধরা হল সামনে। তার আগেই পিটারের ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন নামের গোছা গোছা কার্ড। পিটার-লিন্ডা কবুল করলেন দ্রুত, হ্যাঁ, Mr. Stanley Rodrigues আসলে ‘Magnetic Stripe Reader’–এর সংকেতই। লিন্ডার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল টিম, আলমারির মধ্যে থেকে উদ্ধার হল MSR 205 মেশিনটি। যা দিয়ে তৈরি করা হত জাল কার্ড।