অতঃকিম? বেনসনের খোঁজ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে হদিশ মিলেছে মণিময়েরও। নজরদারিতে থাকা সোর্স খবর দিয়েছে, মণিময়কে দেখা গেছে মল্লিকবাজারে এক প্রৌঢ়ের দোকানে কিছুক্ষণ কাটাতে। কার দোকান? মহাবীর আগরওয়াল, মণিময়ের বাবা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মহাবীরের দুটো বিয়ে। থাকেন আলিপুরে। মণিময় দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান। এবং এলাকায় এই বয়সেই চিটিংবাজ হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছে। মোবাইল নম্বর? পাওয়া গেল। ফোন বন্ধ। শেষ টাওয়ার লোকেশন হরিদ্বার। বেশ, ঘাপটি মেরে আছে। থাক। আজ নয় কাল, ফিরতে তো হবেই কলকাতায়। যাবে কোথায়?
অঙ্কুশের কী খবর? মানিকতলার বাড়ি থেকে বেরচ্ছেই না প্রায়। লিন্ডার গতিবিধিতেও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বেনসনও আছে নিজের মতো।
লিন্ডার বাড়িতে রেইড করে লাভ নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলার একাধিক নাইজেরীয় বন্ধু থাকতেই পারে। তারা লিন্ডার ফ্ল্যাটে রাত কাটাতেই পারে। তাতে কী প্রমাণ হল? আসল ব্যাপার তো কার্ড স্কিমিং এবং তার নেপথ্যের চক্র। সেই চক্রের সঙ্গে এই বিদেশিদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। সে থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দাজের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে উলটো ফলই হবে। চক্রের চাঁই যে বা যারা, সে বা তারা সাবধান হয়ে যাবে।
আরেকটা মুশকিল, লিন্ডা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। ২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা মহিলার মোবাইল ফোন নেই, ভাবাই যায় না। কেন নেই? মোবাইল না নেওয়ার পিছনে কোনও বিশেষ কারণ? কারণ সে যা-ই হোক, এই বেনসন-টেনসনের মতো নাইজেরীয় বন্ধুরা যোগাযোগ করে কী করে লিন্ডার সঙ্গে? ল্যান্ডফোন? রেকর্ড দেখা হল। সন্দেহজনক কিছু নেই।
একটাই রাস্তা পড়ে থাকে যোগাযোগের। ই-মেল। লিন্ডার অফিস থেকে ই-মেল আইডি জোগাড় করতে অসুবিধে হল না। এবার জানা দরকার কার কার সঙ্গে কী কী মেল চালাচালি হয়। জানার উপায়? হ্যাকিং। তদন্তের প্রয়োজনে ততদিনে ‘ethical hacking’ শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা সহ দেশের সর্বত্র। কয়েকজন তুখোড় হ্যাকারের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ ছিলই। যাঁদের একজন লিন্ডার পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করলেন মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যে।
আজকের দিনে পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে আমি-আপনি অনেক সচেতন। সবাই জানি আমরা, অক্ষর-সংখ্যা-গাণিতিক চিহ্ন মিলিয়ে-টিলিয়ে একটা ভজঘট পাসওয়ার্ড তৈরি করা জরুরি। যেটা সহজে ভেদ করা যাবে না। সবাই জানেন, নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলানো দরকার। কিন্তু এ মামলা যখনকার, তখন সাইবার-সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতার মাত্রা ছিল অনেক কম।
লিন্ডাও ওই অসচেতনদের দলে পড়তেন। নিজের জন্মতারিখটা উলটে দিলে যা দাঁড়ায়, সেটা পাসওয়ার্ড হিসেবে রেখেছিলেন। যে তারিখটা লিন্ডার অফিস থেকে জানা হয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দাদের। ‘চিচিংফাঁক’ হয়ে গেল লিন্ডার মেল।
গত কয়েক মাসের মেল ঘেঁটে বোঝা গেল, লিন্ডা পুরো ব্যাপারটা না-ই জানতে পারেন, কিন্তু তাঁর ফ্ল্যাটে যারা যাওয়া-আসা করে, তারা ধোয়া তুলসীপাতা নয়। পিটার বলে একজন প্রায়ই লিন্ডাকে নির্দেশ পাঠায় ই-মেলে। অমুক কাল কলকাতায় এক রাতের জন্য থেকে পরের দিন বাংলাদেশ যাবে, তাকে তোমার ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়ো। তমুকের দিল্লিতে কিছু পুলিশি সমস্যা হয়েছে, আগামীকাল কলকাতায় যাবে। তোমার ফ্ল্যাটে রাতটা থাকবে। এইসব।
পিটারের মেলগুলোর প্রযুক্তিগত কাটাছেঁড়া করে জানা গেল, পাঠানো হয়েছে বিদেশ থেকে। কোন দেশ? নাইজেরিয়া!
হলই বা নাইজেরিয়া, কিন্তু জালিয়াতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ? হয় কিছু প্রমাণ ছাড়া? হতাশ লাগছিল সৌম্যর। তা হলে কি এরা অন্য কোনও ধরনের বেআইনি কাজে যুক্ত? কার্ড স্কিমিং-এ নয়? কিন্তু আপাতত হাতে তো অন্য কোনও লিডও নেই, যে অন্য কোনও গ্যাং-এর খোঁজখবর করা যাবে। এ যা অবস্থা, শুধু পেনাল্টি বক্সের বাইরে পাসের দেওয়া-নেওয়াই চলছে। গোলের মুখ আর খোলা যাচ্ছে কই?
গোলের মুখ খোলার সামান্যতম আভাস মিলল দিনকয়েক পর। রোজই পিটার-লিন্ডার মেল চালাচালিতে চোখ রাখতেন সৌম্য। এক রাতে নিয়মমাফিক ‘হাই-হ্যালো-লাভ ইউ ডিয়ার’-এর পাশাপাশি পিটারের তরফে একটা মেল, ‘Please keep Mr.Stanley Rodrigues safe.’
মানে? Stanley Rodrigues-টা আবার কে? এ তো নতুন মোচড় তদন্তে। যাকে বলে, ‘কাহানি মে টুইস্ট’! কে স্ট্যানলি? সেই মাঝবয়সি, যে দু’মাস অন্তর আসে আর লিন্ডার ফ্ল্যাটে থাকে বেশ কিছুদিন? তা হলে স্ট্যানলিই কি নাটের গুরু? লিন্ডাকে মেল করে স্ট্যানলিকে ‘সেফ’ রাখতে বলছে কেন পিটার? ‘সেফ’ রাখার প্রয়োজন পড়ছে কেন? কী সম্পর্ক স্ট্যানলির সঙ্গে পিটারের? রাখতেই যদি হয়, স্ট্যানলিকে কোথায় ‘সেফ রাখবেন লিন্ডা? এই ফ্ল্যাট ছাড়া অন্য গোপন আস্তানা আছে মহিলার? নজরদারি তো সমানে চলছে। অফিস-বাড়ি আর রোববারে চার্চ, এর বাইরে তো কোথাও যান না মহিলা। বেনসন ছাড়া আর যে নাইজেরীয়রা মাঝেমধ্যে লিন্ডার ফ্ল্যাটে আসে, তাদের মধ্যে কারও কথা বলছে? যদি তা-ই হয়, ঝুঁকি নিয়ে লিন্ডার বাড়িতে রেইড করতে হয়। আর করলেও তখন এই স্ট্যানলি থাকবে, কী গ্যারান্টি? বরং খুঁচিয়ে ঘা করলে হয়তো স্ট্যানলি, যাকে পিটার নিরাপদে রাখার নির্দেশ দিয়েছে লিন্ডাকে, আর এ তল্লাট মাড়ালই না। তখন?