ট্র্যাক করার জন্য যা করণীয় ছিল, করলেন সৌম্য। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) অফিসে পরের দিন দুপর নাগাদ ঢুঁ মারলেন। নিজের পরিচয় গোপন রেখে।
নাইজেরিয়ান ফুটবলারদের লিস্ট পাওয়া যাবে? ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশনের? চলতি মরশুম এবং তার আগের দু’-তিন বছরের?
আইএফএ-র কর্মকর্তা ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে।
—কী দরকার? খেপ?
সৌম্য হাসেন অপ্রস্তুত।
—হ্যাঁ… মানে… কী করে বুঝলেন?
মধ্যবয়সি কর্মকর্তার ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়। যেন মাছকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ভাই সাঁতার শিখলে কী করে?
—ফেব্রুয়ারিতে নাইজেরিয়ান প্লেয়ারের খোঁজ করতে একটা কারণেই লোক আসে।
—দাদা, আমরা আসলে একজন ভাল স্ট্রাইকারের খোঁজ করছিলাম। বেনসন বলে একটা ছেলে শুনেছি ভাল খেলছে ইদানীং। কিন্তু ঠিকানা জানি না। যদি একটু যোগাযোগ করা যায়… সে জন্যই…
—বেনসন? এবার সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছে ছেলেটা। অনেক গোল-টোল করেছে শুনেছি। পরের রার হয়তো ফার্স্ট ডিভিশনে টিম পেয়ে যাবে।
সৌম্য আড্ডা জমানোর চেষ্টা করেন।
—বড় টিম? মানে মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল?
কর্মকর্তা ফের হাসেন। একটা সিগারেট ধরান।
—দুর মশাই। খেপেছেন? অত সোজা? সবাই কি চিমা ওকোরি বা এমেকা ইউজিগো নাকি? ছোট টিমগুলোও এখন বড় চেহারার বিদেশি খোঁজে। যারা অ্যাটাকিং থার্ডে গুঁতোগুঁতি করে গোলটা করে দেবে ঠিক সময়ে। অ্যাটাকিং থার্ড কাকে বলে জানেন তো?
সৌম্য মৃদু হাসেন। ফুটবল নিয়ে কর্মকর্তার কচকচি অসহ্য ঠেকলেও ধৈর্য হারান না। নিজে ভাল ফুটবল খেলতেন ছোট থেকেই। রাজ্য স্তরের ফুটবলে পুরুলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাত জেগে ফলো করেন লা লিগা, ইপিএল-এর প্রতিটা ম্যাচ। মাঠটার প্রতিটা অর্ধ-কে যে তিনটে ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়, ডিফেন্ডিং থার্ড, মিডল থার্ড আর অ্যাটাকিং থার্ড, এই কর্মকর্তার থেকে জানতে হবে?
—মোটামুটি জানি দাদা। তবে আপনার যা এক্সপিরিয়েন্স, আমরা তো নেহাতই বাচ্চা। বেনসনের একটা ছবি পাওয়া যাবে? মানে রেজিস্ট্রেশনের সময় ছবি তো দিতে হয়, সেখান থেকেই যদি… আর ঠিকানাটা…
—রেজিস্টার থেকে যা ছবি বেরয়, খুবই অস্পষ্ট। মুখাবয়ব পরিষ্কার করে বোঝার উপায় নেই। ঠিকানার জায়গায় লেখা আছে, ওয়াইএমসিএ হস্টেল, ধর্মতলা।
তবে ওই হস্টেলে না-ও পেতে পারেন। এরা কলকাতায় এসে সবাই ওখানেই প্রথমে ওঠে। তারপর একটু পয়সাকড়ি হাতে পেলে হয় একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে নেয়। নয়তো ‘পেয়িং গেস্ট’ হয়ে থাকতে শুরু করে কোথাও।
—কিন্তু যোগাযোগ করব কী ভাবে? ধরুন ওয়াইএমসিএ–তে যদি না পাই…
কর্মকর্তা ভদ্রলোক এক মিনিট ভাবেন। সৌম্যর চোখমুখ দেখে বোধহয় একটু মায়াই হয়।
—সেক্ষেত্রে একটাই রাস্তা। মিল্টনদা।
—মিল্টনদা?
—হ্যাঁ, ময়দানের পুরনো লোক। মাঠই ধ্যানজ্ঞান। অফ সিজ়নে খেপ কে কোথায় খেলছে, কে কোথায় খেলবে, পুরোটা জানে। কন্ট্রোল করে। বাটা গ্রাউন্ডে সকাল থেকে পাবেন রোজ।
সঙ্গী অফিসারকে নিয়ে মিল্টনদার কাছে পৌঁছে গেলেন সৌম্য পরদিন সকালে। বেনসনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন, আশ্বস্ত করলেন মিল্টন। দরদাম নিয়েও কথা হয়ে গেল।
—আপনি যখন বলছেন গোলটা ভাল চেনে, তখন না হয় পাঁচই দেব। ফাইনালটা জিততেই হবে যেভাবে হোক।
—আমি যখন বলছি মানে? পরশু একটা খেপ খেলতে যাবে। ইচ্ছে করলে গিয়ে দেখে নেবেন।
—কোথায় খেলা পরশু?
—হাওড়ায়। সাঁতরাগাছি পেরিয়ে।
.
সাঁতরাগাছি পেরিয়ে আরও বেশ কিছুটা। জায়গার নাম উনসানি। বেরতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল সৌম্য আর তাঁর সঙ্গীদের। তার উপর একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়ে সাঁতরাগাছি ব্রিজ নট নড়নচড়ন। যখন গাড়ি গিয়ে মাঠের কাছাকাছি পৌঁছল, সেকেন্ড হাফ শেষ হতে বাকি মিনিট দশেক। ১-১। ম্যাচ শেষ হল ৩-১ স্কোরলাইনে। বেনসন দুটো গোল করল একাই। একটা হেডে। একটা গোলার মতো শটে। শেষ মুহূর্তে একটা শট বারে না লাগলে হ্যাটট্রিক হয়ে যায়। মিল্টন ভুল বলেননি। খেপ খেলায় এই বেনসনকে ম্যাচ পিছু পাঁচ হাজার দেওয়াই যায়।
টিমের বেশিরভাগ প্লেয়ার বাসে করে রওনা দিল কলকাতা। বেনসন চড়ে বসল একটা মারুতি ৮০০ গাড়ির পিছনের সিটে। খেপ-তারকার জন্য আলাদা ট্রিটমেন্ট। দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরে ছুটল মারুতি। পিছনে সামান্য দূরত্বে সৌম্যদের সাদা অ্যাম্বাসাডর।
বেনসনের গাড়ি যখন থামল তিলজলা এলাকার একটা একতলা ফ্ল্যাটের সামনে, সন্ধে নেমেছে কলকাতায়। সেই যে ফ্ল্যাটে ঢুকল, পরের দিন দুপুর অবধি বেরলই না বেনসন। নজরদারি চালু হল অষ্টপ্রহর। দেখা গেল রুটিন বলতে একটা মোটরবাইকে করে সকালে ময়দানে প্র্যাকটিসে যাওয়া আর মধ্য কলকাতার সদর স্ট্রিটে একটা ফ্ল্যাটে পেয়িং গেস্ট হিসেবে বসবাস। মাঝেমধ্যে নিশিযাপন তিলজলায় ওই ফ্ল্যাটে।
কার ফ্ল্যাট? লিন্ডা স্যামুয়েলস। মধ্য তিরিশের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুবতী। সুন্দরী, বিবাহবিচ্ছিন্না। এক ছেলে, নাম সেবাস্তিয়ান। পড়ে মধ্য কলকাতার এক নামী কনভেন্ট স্কুলে। ক্লাস নাইন। লিন্ডা কাজ করেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এক স্টিল কোম্পানির অফিসে। রিসেপশনিস্ট। বেনসন ছাড়াও দু’-একজন নাইজেরিয়ান যুবক মাঝেমাঝে আসে। এক কি দু’দিন থাকে। তারপর চলে যায়। এক মাঝবয়সি নাইজেরীয় অবশ্য মাস দুয়েক অন্তর অন্তর আসেন। আর এলে থাকেন অন্তত দু’সপ্তাহ। এক-দু’দিনের জন্য নয়।