অঙ্কুশকে পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ ছেড়ে দিলেন গোয়েন্দারা। কুড়ি বছরের ছেলেটি লালবাজারের গেট থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটা দিল, জানতেও পারল না, সাদা পোশাকে দু’জন অফিসার নিঃশব্দে অনুসরণ করছেন নিরাপদ দূরত্ব থেকে। যাঁরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, মানিকতলার বাসিন্দা অঙ্কুশ দক্ষিণ কলকাতাগামী মিনিবাসে উঠে বসলেন। নিমেষের মধ্যে একই বাসে সহযাত্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দুই অফিসার।
পার্ক সার্কাসের কাছে নামল অঙ্কুশ। কিছুটা হেঁটে গিয়ে ঢুকল Ice Skating Rink–এর উলটোদিকের এক নামকরা কফিশপে। বেরিয়ে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। ফের হাঁটা দিল পার্ক সার্কাসের দিকে। এবং উঠে পড়ল উত্তরমুখী বাসে। কফিশপের সার্ভিস বয়ের সঙ্গে কথা বললেন অফিসাররা। অঙ্কুশ কিছুই অর্ডার করেনি। শুধু বলে গেছে, ‘আমার নাম অঙ্কুশ। আমার এক বন্ধুর একটু পরে এখানে আসার কথা। দু’জনে একসঙ্গে কফি খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় পুলিশে যেতে হবে। বাড়িতে ক’দিন আগে একটা চুরি হয়ে গেছে। কেস হয়েছে। পুলিশ ডেকেছে লালবাজারে। তাই থাকতে পারছি না। কেউ এসে আমার নাম করে খোঁজ করলে বলে দেবেন, আমি আজ আর আসব না।’
আরও জানা গেল, অঙ্কুশ মাসে এক-দু’বার এখানে আসে কফি খেতে। কখনও একা, কখনও সঙ্গে দু’-তিনজন বন্ধু থাকে। এই বন্ধুদের মধ্যে একজন ছ’ফুটের উপর লম্বা নাইজেরিয়ানও আছে। যাকে ‘বেনসন’ বলে ডাকে অন্যরা। বেশিরভাগ সময় ফুটবলের জার্সি আর শর্টস পরেই আসত বেনসন। সার্ভিস বয় কথায় কথায় জানতে পেরেছিল, বেনসন ফুটবলার। কলকাতা ময়দানে খেলে।
এটুকু বোঝা যাচ্ছিল, অঙ্কুশকে যতটা চালাক ভাবা গিয়েছিল, বাস্তবে তার থেকে একটু বেশিই চতুর। কফির দোকানে যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তার বন্ধু বা বন্ধুদের কাছে ওই সার্ভিস বয়ের মাধ্যমে খবর পৌঁছনো, পুলিশ ‘ট্র্যাক’ করছে। সাবধান!
যে বন্ধুর সঙ্গে অঙ্কুশের কথা ছিল কফিশপে দেখা করার, সে কে? মণিময় আগরওয়াল, যে কার্ড বদলে আনছি বলে পার্ক স্ট্রিটের দোকান থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? না কি অন্য কেউ? কেউ আসেনি অঙ্কুশের খোঁজে। কোনওভাবে খবর দিয়ে দিয়েছিল অঙ্কুশ বাড়ি ফেরার পথে? কোন পিসিও বুথ থেকে ফোন করে দিয়েছিল? কী-ই বা এমন কঠিন!
ডিসি ডিডি মিটিংয়ে বসলেন অফিসারদের নিয়ে। যা যা তথ্য হাতের কাছে ছিল, ঝালিয়ে নেওয়া হল।
এক, অঙ্কুশ ছেলেটা গোলমেলে। সেই জিজ্ঞাসাবাদের পরদিন থেকে মানিকতলার বাড়ি আর পাড়ার বাইরে বেরচ্ছেই না প্রায়। মোবাইল নেই বলে আরও মুশকিল। কার সঙ্গে কীভাবে কখন যোগাযোগ করছে, জানার উপায় নেই।
দুই, মণিময় চক্রের সঙ্গে যুক্ত, সন্দেহ নেই। কিন্তু খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ‘মহম্মদ সিকন্দর’-ই যে মণিময়, তা নিয়েও সংশয়ের জায়গা নেই। কফিশপের সার্ভিস বয় ছেলেটি বিহারি। লাইসেন্সের ছবি দেখে চিহ্নিত করেছে মণিময়কে। এবং জানিয়েছে, মণিময় তাকে বলেছিল, মল্লিকবাজারে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাপড়ের দোকান আছে। ছট পুজোর আগে সস্তায় জামাকাপড় কিনিয়ে দেবে।
সে না হয় হল, কিন্তু মল্লিকবাজারে অসংখ্য কাপড়ের দোকান। কোনটা মণিময়ের আত্মীয়ের, কী করে জানা যাবে? সিদ্ধান্ত হল মল্লিকবাজারে নজরদারির। জাল লাইসেন্সের ছবির প্রিন্টআউট সঙ্গে নিয়ে সোর্সরা মাঠে নামল।
তিন, বেনসন। নাইজেরীয় ফুটবলার। যাকে দ্রুত চিহ্নিত করা দরকার, কোথায় থাকে জানা দরকার। কী করে ফুটবল ছাড়া, জানতে হবে।
—স্যার, অঙ্কুশকে আরেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয় না? সৌম্য প্রশ্ন করেন ডিসি ডিডিকে।
—করাই যায়। কিন্তু লাভ হবে কি কিছু? নতুন কিছু বেরবে? যেটুকু বলেছে, তার বেশি বলবে বলে মনে হয় না। আর যতটা বলেছে, তার থেকে খুব বেশি জানে তারও তো গ্যারান্টি নেই।
—হুঁ…
—একটু তলিয়ে ভাবো… অঙ্কুশ বা মণিময় জালিয়াতি চক্রের অংশ হতেই পারে, কিন্তু এই গ্যাং-এর শিকড় বিদেশে। কলকাতার দুটো ছেলের পক্ষে এই মাপের চক্র চালানো মুশকিল। এরা বড়জোর টিম মেম্বার। আসল পান্ডাদের খুঁজে বার করতে হবে। অঙ্কুশকে আর ডাকার দরকার নেই। ওকে ভাবতে দাও, ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা শ্যাডো করো। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে দেখা করছে, সব…
—আর বেনসন?
—ওটা ইমপরট্যান্ট, ভেরি ইমপরট্যান্ট। ফরেন কানেকশন বলতে আপাতত বেনসনই। ওর সম্পর্কে খোঁজ নাও ডিটেলে। কোথায় থাকে, সেটা জানতে পারলে লোক বসিয়ে দাও বাড়ির সামনে। ওর মুভমেন্টের ব্যাপারেও রাউন্ড-দ্য-ক্লক রিপোর্ট জরুরি।
—ওকে আইডেন্টিফাই করাটা খুব সমস্যা হবে না স্যার। পেয়ে যাব মনে হয়। পেলে তুলে আনব লালবাজারে?
—নো। বাই নো মিনস। আমরা তো এখনও জানিই না ওর কতটা ইনভলমেন্ট। বা আদৌ ইনভলমেন্ট আছে কিনা। কিছু প্রমাণও নেই। কী হবে তুলে এনে? একটা কফিশপে অঙ্কুশ-মণিময়ের সঙ্গে সময় কাটায়। তো? হোয়াট ডাজ় দ্যাট প্রুভ?
—রাইট স্যার…
—জিজ্ঞেস করার মতো কিছু তো নেই এখনও। তারপরও ডাকলে উলটো ফল হবে। আমাদের ছেড়ে দিতে হবে ইন্টারোগেশনের পর। আর যদি সত্যিই ও এই চক্রের সদস্য হয়, তা হলে বেরিয়ে গিয়েই বাকিদের অ্যালার্ট করে দেবে। একটা ফোন, বা একটা ই-মেল, একটা টেক্সট মেসেজ়, ব্যস। আপাতত লোকটাকে ট্র্যাক করে ওর উপর নজরদারি চালানো ছাড়া কিছু করার নেই।