কারও নিখোঁজ হওয়ার খবর পেলে যা যা করণীয় প্রথামাফিক, করা হল। ওয়ারলেস বার্তা শহরের থানাগুলিতে, কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না তার তথ্যতালাশ, নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি সংগ্রহ এবং যথাসাধ্য প্রচারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ফল হল না, বছর পঁয়ত্রিশের পঞ্চম নিখোঁজই।
পঞ্চম শুক্লা
যত সহকর্মী ছিলেন পঞ্চমের, বন্ধুবৃত্তে ছিলেন যাঁরা, প্রস্তুত হল তালিকা। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীনই তাঁদের একজনের থেকে জানা গেল, রামলোচন নামের এক বন্ধুর সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসা করার কথা ইদানীং ভাবছিলেন পঞ্চম। বন্দরে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী, হঠাৎ কাপড়ের ব্যবসা কেন? খোঁজ শুরু হল রামলোচনের। ঠিকানা পাওয়া গেল অচিরেই। তারাতলায় একতলা ফ্ল্যাট তিন কামরার, থাকতেন একাই।
প্রতিবেশীরা জানালেন, ১১ মার্চ ভোরবেলা থেকে রামলোচনকে আর দেখেননি। ঘর তালাবন্ধ। সাদা পোশাকের পুলিশকে লাগানো হল চব্বিশ ঘণ্টার নজরদারিতে।
কিছুদিনের নিষ্ফলা প্রহরার পর ২১ মার্চ ভোররাতে নিজের বাড়িতে চাদরমুড়ি দিয়ে ঢোকার সময় আটকানো হল রামলোচনকে। পুরো নাম রামলোচন আহির। বয়স ত্রিশের কোঠায়, থানায় এনে ঘণ্টাদুয়েকের জেরাতেই প্রকাশ্যে এল পঞ্চম-হত্যার ইতিবৃত্ত।
রামলোচন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। অবাঙালি, কিন্তু বংশপরম্পরায় বাস কলকাতায়। বাবা-ঠাকুরদার পারিবারিক ব্যাবসা ছিল কাপড়ের। রামলোচন ছিলেন ঝুঁকিপ্রবণ প্রকৃতির, শুধুই কাপড়ের ব্যবসায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখায় আগ্রহী ছিলেন না। নানাবিধ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে প্রবল উৎসাহ ছিল। বিদেশে পণ্যরফতানির কথাও ভাবতে শুরু করেছিলেন সম্প্রতি। সেই সূত্রে যাতায়াত বেড়েছিল ডক এলাকায়, আলাপ হয়েছিল পঞ্চমের সঙ্গে। যা দ্রুত পরিণত হয়েছিল সখ্যে।
বাবা-মা দেশের বাড়িতে প্রায় একইসঙ্গে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুকাল আগে জরুরি ভিত্তিতে অর্থের প্রয়োজন হয় পঞ্চমের। চিকিৎসা ছিল প্রভূত খরচসাপেক্ষ। শরণাপন্ন হলেন অর্থবান বন্ধুর। বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ালেন রামলোচন। পাঁচশো টাকা ধার দিলেন। সে-সময়ে, ছয়ের দশকে, পাঁচশো মানে অনেক টাকা।
গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির ব্যবসার কথা বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন রামলোচন, বিনিয়োগও করে ফেলেছিলেন বহুলাংশে। কিন্তু ব্যবসাকে একটা ভদ্রস্থ জায়গায় দাঁড় করাতে আরও অর্থের জোগান একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। পঞ্চমের কাছে ধার দেওয়া টাকা ফেরত চাইলেন। পঞ্চম জানালেন, চেষ্টা করবেন শোধ করতে, কিন্তু আপাতত অপারগ।
নিয়মিত তাগাদা শুরু করলেন রামলোচন, তাঁরও আশু প্রয়োজন অর্থের। এই নিয়েই ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে একদিন তীব্র বচসা।
—আমার টাকা চাই তিনদিনের মধ্যে। না হলে পুলিশে যাব।
—যা না, কোনও প্রমাণ আছে? লেখাজোকা তো কিছু হয়নি, আমি পুলিশকে বলব, টাকা নিইনি।
—ঠিক আছে, আমিও দেখাব, আমার টাকা মেরে দিয়ে তুই পার পাবি ভেবেছিস?
—বললাম তো, যা করার করে নিস।
ক্রোধান্ধ রামলোচন সেদিনই স্থির করলেন, পঞ্চম বাঁচার অধিকার হারিয়েছেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখা করলেন পঞ্চমের সঙ্গে।
—পঞ্চম, তোর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর থেকেই মনটা খারাপ। তুই কিছু মনে করিস না ভাই।
—সে তো আমারও মেজাজটা তেতো হয়ে আছে সেদিনের ঘটনার পর থেকে। আমি কি বলেছি টাকা দেব না?
—আরে ছাড়, যা হওয়ার হয়েছে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।
—কী?
—গাড়ির পার্টসের ব্যবসাটা ঠিক জমছে না। কাপড়ের ব্যবসার ঘাঁতঘোঁত আমার হাতের তালুর মতো জানা। ওটাই ভাল করে করব ভাবছি। একজন রাজি হয়েছে টাকা ঢালতে, পরশু বাড়িতে আসবে। তুইও আয়।
—কিন্তু আমি গিয়ে কী করব?
—আরে তুই চাকরির পর ফ্রি-টাইমে লেবার দিবি। হুট করে তো আর টাকার জোগাড় করতে পারবি না। এভাবে শোধ দিবি আস্তে আস্তে। ঝগড়া করে কী লাভ?
পঞ্চম সম্মত হয়ে গেলেন রামলোচনের প্রস্তাবে। নির্ধারিত দিনে রাত আটটায় পৌঁছলেন বন্ধুর বাড়ি। পানাহার হল। দশটা নাগাদ সামান্য অধৈর্য হয়ে পড়লেন পঞ্চম।
—ঘুম পাচ্ছে রে এবার। কখন আসবে তোর ব্যবসায়ী বন্ধু?
—এসে যাওয়ার তো কথা। কেন যে দেরি করছে? মনে হয় আটকে গেছে কোথাও। এক কাজ করি চল, হেঁটে আসি একটু ঝিলের পাশ থেকে, যা গুমোট গরম। পাশেই তো, মিনিট পনেরো হাওয়া খেয়ে চলে আসব। তারপর তুই বাড়ি চলে যাস। আমিও চলে আসব।
—হুঁ … চল।
ঝিলের পাড়ে কিছু সময় কাটল গল্পগুজবে। ঘন হয়ে এসেছে অন্ধকার। রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ পঞ্চম বললেন, চল, এবার বাড়ি যাই।
উঠতে যাবেন, সহসা জামার ভিতরে গোঁজা ধারালো ছুরি বার করলেন রামলোচন। চালিয়ে দিলেন পিছন থেকে, পঞ্চমের ঘাড়ে। আকস্মিক আঘাতের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না শক্তসমর্থ চেহারার পঞ্চম, বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই একের পর কোপ বসিয়ে দিয়েছেন রামলোচন। রক্তাক্ত এবং ভূপতিত পঞ্চমের উপর নির্বিচার ছুরিকাঘাত এর পর, বুকে-পেটে-গলায়। মৃত্যু এল অনিবার্য।
—তারপর?
—ভেবেই রেখেছিলাম আগে। বডিটাকে পুঁতে দিলাম ঝিলের কাদাজলের মধ্যে। জলেই ফেলে দিলাম ছুরিটা, যেটা বাবা শখ করে কিনেছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লি থেকে। জামার ভিতর গুঁজে নিয়ে গিয়েছিলাম ঝিলে। আমার টাকা দিচ্ছিল না পঞ্চম, আবার রোয়াবও দেখিয়েছিল, মাথার ঠিক ছিল না তাই। ভুল করে ফেলেছি স্যার, স্রেফ রাগের মাথায়।