এবার শাগরেদ কী করল, সোনার দোকানে গিয়ে ১০০ ডলার খরচ করে গয়নাগাটি কিনল। মানে, সাত হাজার টাকার গয়না। মার্কিন ভদ্রলোকের কার্ড থেকে ১০০ ডলার লোপাট হয়ে গেল। এবং চোর গয়না নিয়ে চম্পট। দোকানের মালিক জানলেন না, অমুকের কার্ডের তথ্য নিয়ে তমুককে গয়না বেচে দিলেন। বেচার সময় কার্ডটা দোকানে রাখা ছোট্ট মেশিনটায় ঘষে একটা ‘চার্জস্লিপ’ নামের যে চিরকুট বেরল, সেই স্লিপ ব্যাংকে জমা দিয়ে পরের দিন সাত হাজার টাকা তুলেও নিলেন দোকানি।
টনক নড়ল কখন? যখন সেই মার্কিন ভদ্রলোক নিজের ব্যাংকে গিয়ে হইচই করলেন। এটা কী ব্যাপার? আমার কার্ড থেকে সাত হাজার টাকার গয়না কেনাকাটার খরচ দেখানো হয়েছে। তা-ও আবার ভারতে গিয়ে। ইয়ার্কি নাকি? ভারতে যাইই নি কখনও! সত্যিই যাননি, পাসপোর্ট জানান দিচ্ছে স্পষ্ট। আমেরিকার ব্যাংক এবার ভারতীয় ব্যাংকের কাছে ১০০ ডলার চেয়ে পাঠাল অকাট্য তথ্যপ্রমাণ সমেত। ভারতীয় ব্যাংক নিজের কোষাগার থেকে টাকা দিতে বাধ্য হল। অথচ গয়নার দোকানদারকে সেই টাকাটা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে চার্জস্লিপ অনুযায়ী। গয়না কেনার নথি তো কার্ডে ঠিকঠাকই ছিল। দোকানে খোঁজ নেওয়া হল। দোকানি বললেন, কোনও বিদেশি ওই গয়না কেনেনি। তা হলে?
‘তা হলে’-র একটাই উত্তর। বিদেশি ভদ্রলোকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ভারতীয় কার্ডে সেই তথ্য ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। স্কিমিং! যার জেরে আইসিআইসিআই ব্যাংককে লক্ষ লক্ষ টাকা খেসারত দিতে হচ্ছিল।
দেশের কোথাও তখনও, সেই ২০১০ সালে, এমন কোনও ঘটনা লিপিবদ্ধ নয়, যেখানে ‘কার্ড স্কিমিং’ করে লক্ষ লক্ষ টাকা নয়ছয় হয়েছে। সাম্প্রতিক এটিএম জালিয়াতিতে রোমানিয়ার নাগরিকরা জড়িত ছিল। ভারতীয়দের কার্ডের তথ্য চুরি করে দুষ্কর্মটা ভারতীয় ব্যাংকের এটিএম-এই হয়েছিল। কিন্তু দশ বছর আগের এই মামলায় অবশ্য দেখা যাচ্ছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ‘স্কিমিং’ করা হয়েছে ভারতে। মানে, চক্র বিস্তৃত আমেরিকা পর্যন্ত!
ঘোর দুশ্চিন্তার কারণ ছিল লালবাজারের। এক তো এ ধরনের অপরাধ ঘটেছে প্রথম। তদন্তের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। দুই, চক্রের একাংশ যদি থাকে বিদেশে, আর বাকিটা এদেশে, একটা আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা। কিন্তু তা বলে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। এই গ্যাংটাকে ধরতে তো হবে।
‘ধরতে হবে’ ভাবা এক, আর ‘ধরা’ আরেক। ‘লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে!’ চেনা ছকের বাইরে অপরাধ। কাজে আসবে না সোর্স নেটওয়ার্ক। পুলিশই ভাল করে জানত না, কীভাবে এই জালিয়াতিটা করা যায়। সোর্স কী করে জানবে? অপরাধীদের সম্পর্কে কিছু ‘ক্লু’ পেলে তবেই সোর্সকে কাজে লাগানোর প্রশ্ন। আপাতত হাতে তথ্য কী? শুধু ওই জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেরক্স। আবছা মুখাবয়ব। নাম মহম্মদ সিকন্দর।
শহরের থানাগুলোকে সতর্ক করা হল। খবর পৌঁছে দেওয়া হল এলাকার সেই সমস্ত দোকানগুলোতে, যেখানে কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটার ব্যবস্থা রয়েছে। বলে দেওয়া হল, কেনাবেচার সময় চোখ-কান খোলা রাখতে। কোনও কার্ডের ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ হলেই পুলিশকে জানাতে সঙ্গে সঙ্গে। এবং মামলা রুজু হওয়ার দিনদশেক পরে প্রথম খবর এল পার্ক স্ট্রিট থানায়।
‘খবর’ বলতে, একটা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস-এর দোকানে দু’জন অল্পবয়সি ছেলে এসেছিল ল্যাপটপ কিনতে। সঙ্গে কার্ড। কিন্তু কার্ড ‘সোয়াইপ’ করার পর দেখা যায়, কার্ডের নম্বরের সঙ্গে প্রিন্ট স্লিপের কিছু তফাত আছে। একটি ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যজন? গেছে অন্য কার্ড আনতে।
থানা থেকে ‘ব্যাংক ফ্রড’ সেকশনে খরব আসতেই সঙ্গী অফিসারদের নিয়ে ছুটলেন সৌম্য। সুরাহা বোধহয় হয়েই গেল তদন্তের। আর সুরাহা! বছর বিশেকের যে ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখে দোকানে বসে ছিল, তার নাম অঙ্কুশ তেওয়ারি। কলেজের গণ্ডি সবে ছাড়িয়েছে। বেকার। বাড়ি মানিকতলায়। আটক করা হল। জেরার পর্বটা তুলে রাখা হল লালবাজারে ফেরা পর্যন্ত। যে ছেলেটির অন্য কার্ড নিয়ে ফিরে আসার কথা, তার জন্য অপেক্ষা করা হল অনেকক্ষণ। কিন্তু সেই ছেলেটা সেই যে গেল, গেল তো গেল, আর এল না।
কে ছেলেটি? লালবাজারে রাতভর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে অঙ্কুশ জানাল, ছেলেটির সঙ্গে অল্প দিনেরই পরিচয়। নাম, মণিময় আগরওয়াল। আলাপ মিডলটন স্ট্রিটের এক চায়ের দোকানে। ছেলেটি দিনকয়েক আগে অঙ্কুশকে অনুরোধ করে, ‘তুই তো ভাই বেশ টেকস্যাভি, আমি একটা ল্যাপটপ কিনব ঠিক করেছি, দোকানে যাবি আমার সঙ্গে? স্পেসিফিকেশনগুলো জাস্ট বুঝিয়ে দিস কেনার সময়। যাতে ঠকে না যাই।’
—কোথায় থাকে মণিময়?
— ঠিকানা জানা নেই, তবে বলেছিল, আলিপুরের দিকে।
—মোবাইল নম্বর?
— মোবাইল আছে মণিময়ের, কিন্তু নম্বর জানি না।
—নম্বর জানা নেই মানে?
—সত্যি জানি না স্যার! আমার নিজের মোবাইল নেই। ওর মোবাইল নম্বর নেওয়ার দরকার পড়েনি সেভাবে।
উৎসাহিত হওয়ার মতো সূত্র একটাই। ড্রাইভিং লাইসেন্সে যে মহম্মদ সিকন্দরের ছবি ছিল, সেটা অঙ্কুশকে দেখানো হল। এবং অঙ্কুশ জানাল, এই ছবির সঙ্গে মণিময়ের মুখের প্রায় হুবহু মিল।