এবার রাম যখন জানতে পারছে যে তার টাকা অন্য কেউ হাওয়া করে দিয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই দ্বারস্থ হচ্ছে ব্যাংকের। ফেটে পড়ছে ক্ষোভে। ব্যাংকের কাছে দাবি করছে লোপাট হয়ে যাওয়া টাকার ক্ষতিপূরণ। মার্কিন ব্যাংক তখন আর কী করবে? ভারতের যে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে জালিয়াতিটা হয়েছে, তাদের কাছে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সহ চিঠি পাঠাচ্ছে, ‘আমাদের গ্রাহকের হকের টাকা ফেরত দাও।’ ফেরত না দিয়ে উপায় নেই। দিতে হচ্ছে, এবং ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
আইসিআইসিআই ব্যাংক শিকার হয়েছে এই জালিয়াতির। যার ব্যাপ্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। দশ-বিশ হাজারের ব্যাপার নয়। ক্ষতির অঙ্ক লাখ ছাড়িয়ে কোটি ছুঁয়ে ফেলবে এভাবে চললে।
নগরপাল প্রশ্ন করেন ব্যাংককর্তাকে, ‘আপনাদের ইন্টারন্যাল এনকোয়ারি কী বলছে?’
—সেটা তো চলছেই স্যার। কিন্তু ট্র্যাক পাওয়া যাচ্ছে না কিছু। গত পরশু অবশ্য একটা জিনিস ঘটেছে।
—কী?
—শহরের যেখানে যেখানে আমাদের EDC (Electronic Data Counter) আছে, সবাইকে আমরা অ্যালার্ট করে দিয়েছিলাম। বউবাজারের একটা দোকানে একটা ছেলে গতকাল বেশ দামি একটা সোনার চেন কিনে ক্রেডিট কার্ড দিয়েছিল। কার্ড দেখে দোকানের লোকের একটু সন্দেহ হয়। ছেলেটার কাছে আইডি প্রুফ দেখতে চাওয়া হয়। তখন এটা দিয়েছিল। এই যে…
পকেটে হাত ঢুকিয়ে যে কাগজটা বার করে আনেন ভদ্রলোক, সেটা একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সের জেরক্স। মুখের অবয়ব আবছা।
—স্যার, আমরা ভেরিফাই করেছি মোটর ভেহিকলস থেকে। এটা জাল।
নগরপাল চোখ বুলোন জেরক্সটায়। লাইসেন্সে নাম, মহম্মদ সিকন্দর।
—ঠিক আছে। একটা লিখিত অভিযোগ করুন লোকাল থানায়। রেজিস্টার্ড হয়ে যাক কেসটা।
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাওয়ার পর ইন্টারকমে ডিসি ডিডি-কে ধরেন সিপি।
—Anti Bank Fraud সেকশনের অফিসারদের নিয়ে বসতে চাই একবার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
.
কার্ড স্কিমিং(Card Skimming)। শব্দ দুটো এখন শুধু পুলিশ নয়, প্রায় সবাই জেনে গেছেন। খবরের কাগজের দৌলতে স্কিমিং নিয়ে একটা প্রাথমিক ধারণাও হয়ে গেছে অনেকেরই। কয়েকমাস আগে এটিএম জালিয়াতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল কলকাতায়। বহু মানুষের টাকা লোপাট হয়ে গিয়েছিল। মূল চক্রী ছিল কয়েকজন রোমানিয়ান নাগরিক। খুব দ্রুত যাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরা গিয়েছিল বলে রক্ষে। না হলে আরও কত মানুষের কষ্টের টাকা যে বেমালুম উধাও হয়ে যেত, ঠিকঠিকানা নেই।
এ কাহিনি আজ থেকে আট বছর আগের। তখন ‘কার্ড স্কিমিং’ ব্যাপারটা যে কী, খায় না মাথায় দেয়, খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না অফিসারদের। শব্দ দুটো শোনা ছিল বড়জোর, এই পর্যন্তই। ‘Anti Bank Fraud’ বিভাগটাই চালু হয়েছিল মাত্র বারো বছর আগে। ২০০৬ সালে।
ব্যাংকের তরফে শেক্সপিয়র সরণি থানায় যে মামলাটা দায়ের করা হল, তার তদন্তভার পড়ল সাব-ইনস্পেকটর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বর্তমানে বড়বাজার থানার ওসি) উপর। সিপি অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বুঝিয়ে বললেন স্কিমিংয়ের ব্যাপারে। এবং স্পষ্ট জানালেন, দ্রুত কিনারা করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই জালিয়াতি চলতে থাকলে একটা সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের টাকা আর নিরাপদ থাকবে না। সুতরাং চাই অঙ্কুরেই বিনাশ।
অঙ্কুরে বিনাশ বললেই তো আর হল না। অপরাধের কী-কেন-কখন জানলে তবেই না অপরাধীর খোঁজ! ইন্টারনেট ঘেঁটে, বইপত্র পড়ে স্কিমিং সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করলেন সৌম্য। যথাসাধ্য বোঝালেন সতীর্থদেরও।
ক্রেডিট কার্ডের পিছনে যে বাদামি রঙের রেখাটা থাকে, তার মধ্যে অদৃশ্যভাবে ঢোকানো থাকে কিছু তথ্য। যা সাধারণ ব্যাংক কর্মচারীদেরও জানার কথা নয়। সেই তথ্য চুরি করল কেউ। এবং প্রযুক্তির সাহায্যে অন্য ক্রেডিট কার্ডের পিছনের বাদামি রেখাটার ভিতর ঢুকিয়ে সেই কার্ড ব্যবহার করল। এটাই ‘স্কিমিং’। কিন্তু চুরিটা হয় কী করে?
আপনি এটিএম কাউন্টারে গেলেন। কম্পিউটার স্ক্রিনের নীচে যেখানে একটা সবুজ রঙের যন্ত্রে লেখা থাকে, ‘Insert your card here’, সেখানে নিয়মমতো কার্ড ঢোকালেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না যে ওই যন্ত্রটির ওপরে লাগানো একটা অন্য যন্ত্রে (স্কিমিং ডিভাইস) মুহূর্তে রেকর্ড হয়ে গেল কার্ডে সঞ্চিত তথ্য। এরপর কি-বোর্ডে টাইপ করলেন গোপন পিন নাম্বার। কিন্তু বুঝতে পারলেন না কি-বোর্ডের উপর নিখুঁত লাগানো আরেকটা কি-বোর্ডের মতোই দেখতে যন্ত্রের মাধ্যমে রেকর্ড হয়ে গেল আপনার পিন নাম্বার।
এটিএম ছেড়ে আপনি বেরিয়ে গেলে বাকিটা ‘এসো ভাই, বোসো ভাই, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’-এর মতো সোজা। জালিয়াতরা কাউন্টারে ঢুকে খুলে নিয়ে গেল সেই স্কিমিং ডিভাইস, যেটা তারা আগে থেকে লাগিয়ে রেখে গিয়েছিল। এবার চুরি করা তথ্যের মাধ্যমে ডামি কার্ড তৈরি করা এবং অন্যের টাকা আত্মসাৎ করা কোনও ব্যাপারই না।
আইসিআইসিআই ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, নগরপালকে যা সংক্ষেপে বলেছিলেন ব্যাংককর্তা, সেটা আরও বিশদে জানলেন সৌম্য। কী? ধরা যাক, আজকের বাজারে ভারতীয় মুদ্রায় ১ ডলারের বিনিময়মূল্য ৭০ টাকা। এবার ধরুন, কোনও মার্কিন ভদ্রলোকের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করল কেউ। তথ্য চলে এল ভারতে, শাগরেদের কাছে। ভুল ঠিকানা দিয়ে একটা ভারতীয় ক্রেডিট কার্ড যে আগেই তুলে রেখেছিল। যাতে ব্যালান্স ছিল জিরো।