—দিদার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। দিদা চিৎকার করতে যেতেই কাকা ডাইনিং টেবিলের কোণে পড়ে থাকা একটা কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তারপর মুখে ঘুসি মারল খুব জোরে। আমি ছুরিটা বার করলাম। আমাদের তো চিনেই গেছে। মেরে ফেলা ছাড়া উপায়ও নেই। না হলে জেলের ঘানি টানতে হবে। গলায় চালালাম ছুরি। তারপর পেটে।
দিদা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। আমি ছুরিটা দিদার নাইটিতে মুছে নিলাম। রেখে দিলাম ব্যাগে। অনেক চেষ্টা করেও আলমারিটা খুলতে পারলাম না। চাবিই পেলাম না। ক্যাশ বলতে পেলাম বাইরে এদিক-ওদিক যা ছিল ব্যাগে-ট্যাগে, হাজার দুয়েক মতো। দিদার গলা থেকে সোনার চেন আর হাত থেকে চুড়ি খুলে নিলাম। যখন এসব চলছিল, তখন একবার বেল বেজেছিল। আমরা খুলিনি। একটু পরে চুপচাপ দরজা খুলে ফাঁক করে যখন দেখেছি কেউ নেই, তখন চট করে নেমে গিয়েছি।
মলয় বোঝেন, ওই যে একবার বেল বেজেছিল, ওটা শুভঙ্কর বাজিয়েছিলেন। আনন্দবাজারের কর্মী।
সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল ঠাসবুনোট। যে ব্যাগে ছুরি নিয়ে এসেছিলেন, ফেরার ট্রেন ধরার সময় বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন সুশীল। বয়ান অনুযায়ী উদ্ধার হল সেই ছুরি। লুঠ করা গয়না বারুইপুরের এক দোকানে বন্ধক রেখেছিলেন স্বপন। উদ্ধার হল সেগুলোও, দোকানি আদালতে চিহ্নিত করলেন স্বপনকে। আর মানসী শনাক্ত করলেন মায়ের গয়না।
আলমারি আর চায়ের কাপে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেল আততায়ীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট। স্বপন একটা আংটি পরতেন ডান হাতে। যে হাতে মঞ্জুকে ঘুসিটা মেরেছিলেন, গাল ছড়ে গেছিল মঞ্জুর। ওই ‘abrasive wound’ যে আংটির আঘাতে হওয়া সম্ভব, তারও উল্লেখ ছিল ফরেনসিক রিপোর্টে। সর্বোপরি আদালতে স্বপন স্বেচ্ছায় জবানবন্দিও দিয়েছিলেন, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে।
২০১৭-র সেপ্টেম্বরে রায় বেরিয়েছিল। দোষী সাব্যস্ত করে সুশীল-স্বপনকে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত করেছিলেন বিচারক।
পরিচিত ভেবে মঞ্জু দরজা খুলেছিলেন, বিশ্বাস করে। চা খাইয়েছিলেন। তারপর খুন হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো যেমন পাপ, কখনও কখনও মানুষকে বিশ্বাস করাও? শেষ বিচারে তা হলে কী দাঁড়ায় এ মামলার নির্যাস?
বিশ্বাসই বিশ্বাসঘাতক।
২.১০ ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন
[কার্ড ক্লোনিং মামলা
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বড়বাজার থানার ওসি। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত ‘প্রশংসা পদক’-এ সম্মানিত। ২০১৪ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’।]
একবার দেখলে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে হয়।
মহিলা সত্যিই চোখ টানার মতো সুন্দরী। দেখে মনে হয় বয়স মাঝতিরিশ। ববকাট চুলে আঙুল চালাচ্ছেন ট্যাক্সি থেকে নেমে। যেটা এসে থেমেছে বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটের ঠিক সামনে।
প্রি-পেইড ট্যাক্সি বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলোচ্ছিলেন সৌম্য। দেখার মতো কিছু থাকে না এয়ারপোর্টে। কী বাইরে, কী ভিতরে। সব শহরেই একই ছবি। একই ধাঁচের বিল্ডিং। একের পর এক গাড়ি এসে থামছে বাইরের রাস্তায়। হয় অ্যারাইভালে, নয় ডিপার্চারে।
যাঁরা উড়ে যাবেন অন্য শহরে, তাঁরা লাগেজ ট্রলি টেনে এনে মালপত্তর রাখছেন। এগোচ্ছেন এন্ট্রি গেটের দিকে। যাঁরা ঝাড়া হাত-পা, তাঁরা গাড়ি থেকে নেমে আরও আগে পৌঁছে যাচ্ছেন গেটে। যন্ত্রও লজ্জা পাবে, এমন মুখ করে টিকিট চেক করছেন বিমানবন্দরের কর্মী। সজাগ দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ করছেন পাশে দাঁড়ানো সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী।
যাঁদের উড়ান এই শহরমুখী, বেরনোর গেটে তাঁদের জন্য ভিড়। আত্মীয়স্বজন যত, তার থেকে বেশি জটলা ড্রাইভারদের। একটু পরেই যাঁরা আরোহী হবেন পার্কিংয়ে থাকা গাড়িগুলোর, তাঁদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষমাণ। চোখ ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে। যার লেখাগুলো ঘনঘন পালটাচ্ছে। অমুক ফ্লাইট ইজ় ডিলেইড। তমুক ফ্লাইট হ্যাজ় জাস্ট ল্যান্ডেড।
এয়ারপোর্ট বড্ড একঘেয়ে লাগে সৌম্যর। শহরের নামটা শুধু বদলে দিলেই হল। বাকি সব মোটামুটি উনিশ-বিশ। বাইরের ভিড়ের মধ্যেও একটা দমবন্ধ শৃঙ্খলা। চলো নিয়মমতে। এর থেকে স্টেশন ভাল। তুমুল ভিড়ভাট্টা আছে। পারিপাট্যের অভাব আছে। হকারের হইহই আছে। কিন্তু চরিত্র আছে। প্রাণ আছে। এক এক শহরে এক এক রকমের স্থাপত্য। শুধু নাম বদলায় না। বাড়িও বদলে যায়।
এলোমেলো ভাবনায় ছেদ পড়ে সঙ্গী অফিসারের কনুইয়ের গুঁতোয়।
—স্যার… ওই দেখুন.. লিন্ডা!
সতীর্থের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করেন সৌম্য। ববকাট চুলের সুন্দরী দাঁড়িয়ে পড়েছেন বেরিয়ে আসার গেটের সামনে। একবার চোখ রাখলেন কবজিতে বাঁধা ঘড়িতে। তাকালেন ডিসপ্লে বোর্ডে।
কোন ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছেন মহিলা, জানা ছিল সৌম্য এবং সঙ্গীদের। দুবাই টু কলকাতা, এমিরেটস-এর উড়ান কলকাতার মাটি ছুঁল আধঘণ্টার মধ্যেই। অন্য অনেকের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন এক সুগঠিত চেহারার যুবক। যাঁকে বেরতে দেখেই এগিয়ে গেলেন মহিলা। জড়িয়ে ধরলেন আলতো। এবং আলিঙ্গনপর্ব শেষ হতে না হতেই দেখলেন, দুই মহিলা সহ চারজন ঘিরে ধরেছেন আচমকা। যাঁদের একজন সরাসরি যুবকের হাত চেপে ধরেছেন, কোনও ভূমিকা না করেই অল্প কথায় বলেছেন, যা বলার ছিল।